Friday

" শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা রচনার প্রথম শর্ত "

 মলয় রায়চৌধুরী
এক
মধ্যপ্রদেশ বাংলা অ্যকাডেমি কতৃপক্ষ কিছুকাল আগে অনুষ্ঠিত একটি সন্মেলনে বহির্বঙ্গ থেকে আসা সাহিত্যিকদের কাছে হাংরি আন্দোলনের প্রসঙ্গ উথ্থাপন করে জানতে পারেন যে সন্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা কেউই এই শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের নাম শোনেননি, এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও কাজ সম্পর্কে জ্ঞান তো দূরের কথা । দিল্লির দিগঙ্গন  পত্রিকা যখন তাঁদের ১৪১১ উৎসব সংখ্যার জন্যে লেখা চাইলেন, আমার মনে হল দিল্লির লেখকরাও এই আন্দোলনের কথা শোনেননি, বা শুনে থাকলেও অপপ্রচারের দরুণ তাঁরা একটা ধোঁয়াটে ধারণা তৈরি করে ফেলেছেন হয়ত । আন্দোলনটা যেহেতু আমিই আরম্ভ করেছিলুম, তাই অল্প-পরিসরে আন্দোলনের ইতিহাস ও ভাববিশ্ব তুলে ধরা যেতে পারে।

১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম । একটা হল ইতিহাসের দর্শন  যা পরে বিংশ শতাব্দী  পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার  যা পরে গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে। হাংরি আন্দোলনের হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার-এর ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম  বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলোনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে ।

উপরোক্ত রচনা দুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর লেখা দি ডিক্লাইন অব দিওয়েস্ট  বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈব প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে । কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন । আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে ও প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । এখানে বলা ভালো যে আমি কলকাতার আদিনিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের  বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে সেভাবে খোলসা হয় যা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয় ।

ওই চিন্তা-ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েরও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন । আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই যে আমরা হাংরি নামের একটা আন্দোলন আরম্ভ করব । ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে-সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন । দাদার শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমিক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্হ হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য-এর প্রেমের কবিতাগুলো শীলার প্রেমে লিখিত । দাদার চাইবাসার বাড়ি , যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্যতম শহর তখন ছিল বনাঞ্চল। দাদার চালাঘরটি ছিল নিমডি নামে সাঁওতাল-হো অধ্যুষিত গ্রামের পাহাড় টিলার ওপর, যা সে-সময়ে ছিল তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসটির পটভূমি ও চরিত্র সবই চাইবাসা-কেন্দ্রিক; তাঁর সন্তু হল দাদার শ্যালক সন্তু এবং কাকাবাবু হল সন্তুর কাকাবাবু। সে যাই হোক, ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয় , এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমারা ওই চার জনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।


ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদেরব ওপর, অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম স্পেসিফিক বা সময়-কেন্দ্রিক । কল্লোল গোষ্ঠি এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনোয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত । সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে , এবং স্হানিকতা ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে

১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র  থেকে পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র  গড়ে তুলতে । সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুণ প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে নিরুপণ করা হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণবের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই জন্যই, ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে, ব্যক্তি-প্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো।কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজি-বলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতত্বের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব বা শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক ম্যাক্রো-পরিসরে  পাবো মনসা বা চণ্ডী বা শিব বা কালিকা বা শিতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ , তার রচয়িতারা নন । তার কারণ সৃজনশিলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে।

ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে স্পেস বা স্হানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী, যখন কিনা ভাষা তৈরির ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড । একদিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব; অন্যদিকে সময়কে একটিমাত্র রেখা-বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী , বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যা।এ । বাদ দেবার এই ব্যাপারটা, আমি সে-সময়ে যতটুকু বুঝেছিলুম, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ি বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোর্সটি উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় , যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালির সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যাওয়ায় । আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবিলেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়-রেখাটিতে । একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই, এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি , কাউনসিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব এ বি শাহ , পি ই এন ইনডিয়া-র অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকার-এর কাছ থেকে।

অমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল । ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্হানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি , রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল  সদস্যদের ক্ষেত্রে ( হেনরি লুইভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে । একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময়কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়, উত্তরঔপনিবেশিক আমলে আবার স্হানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দনকাঠামো থেকে নিষ্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল । তা না হলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবিআঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন ?


দুই
হাংরি আন্দোলনের সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত , ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত । ১৯৬৫কে কেন আন্দোলনের সমাপ্তি চিহ্ণিত করা হয় সে-করণে পরে আসছি। এই সংক্ষিপ্ত সময়কালে শতাধিক ছাপানো ও সাইক্লোস্টাইল-করা বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল, অধিকাংশ হ্যন্ডবিলের মতন ফালিকাগজে , কয়েকটা দেয়াল-পোস্টারে, তিনটি এক ফর্মার মাপে, এবং একটি ( যাতে উৎপলকুমার বসু- পোপের সমাধি  কবিতাটি ছিল ) প্রকাশ করা হয়েছিল কুষ্ঠি-ঠিকুজির মতন দীর্ঘ কাগজে । এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে সাহিত্যকৃতি প্রকাশ , এরও পেছনে ছিল সময়কেন্দ্রিক ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জের প্রকল্প । ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের পাঠবস্তুতে তো বটেই , মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র প্রজন্ম থেকে বাংলা সন্দর্ভে প্রবেশ করেছিল শিল্প-সাহিত্যের নশ্বরতা নিয়ে হাহাকার । পরে, কবিতা পত্রিকা সমগ্র, কৃত্তিবাস পত্রিকা সমগ্র, শতভিষা পত্রিকা সমগ্র , ইত্যাদি দুই শক্ত মলাটে প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপের এই নন্দনতাত্বিক হাহাকারটিকে । পক্ষান্তরে, ফালিকাগজে প্রকাশিত রচনাগুলো দিলদরাজ বিলি করে দেয়া হতো , যে-প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাকঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতাবোধের গর্ব। সেইসব ফালি কাগজ, যাঁরা আন্দোলনটি আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা কেউই সংরক্ষণের বোধ দ্বারা তাড়িত ছিলেন না, এবং কারোর কাছেই সব কয়টি পাওয়া যাবে না । ইউরোপীয় সাহিত্যে নশ্বরতাবোধের হাহাকারের কারণ হল ব্যক্তিমানুষের ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্রিয় ভূমিকা প্রদান । যে-ট্র্যাজেডিভাবনা গ্রেকো-রোমান ব্যক্তি-এককের পতনযন্ত্রণাকে মহৎ করে তুলেছিল; পরবর্তীকালের ইউরোপে তা বাইবেলোক্ত প্রথম মানুষের 'অরিজিনাল সিন' তত্বের আশ্রয়ে নশ্বরতাবোধ সম্পর্কিত হাহাকারকে এমন গুরুত্ব দিয়েছিল যে এলেজি এবং এপিটাফ লেখাটি সাহিত্যিক জীবনে যেন অত্যাবশ্যক ছিল।

আন্দোলনকে রূপ দেবার জন্যে আমরা পরিকল্পনা করেছিলুম যে সম্পাদনা ও বিতরণের কাজ দেবী রায় করবেন , নেতৃত্ব দেবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গঠিত করার কাজটি দেখবেন দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আর ছাপা আর ছাপানোর ভার আমি নেব । প্রথমেই অসুবিধা দেখা দিল। পাটনা শহরে, তখন যে-শহরে আমি থাকতুম, বাংলা ছাপাবার প্রেস পাওয়া গেল না । কেননা একমাত্র প্রেসটি, যারা ইতোপূর্বে মাণিক ভট্টাচার্য-র পত্রিকা ছাপতেন, তারা রাজি হল না ; অন্যান্য প্রেসগুলোর কাছে কেবল শ্রাদ্ধ ও বিয়ের কার্ড ছাপাবার বাঁধা ম্যাটার ছিল। ফলে, ১৯৬১ সালের নভেম্বরে, শক্তিদার জন্মদিনে, যে বুলেটিন প্রকাশিত হল, তা হল ইংরেজিতে । অনেকে পৃষ্ঠপট না জেনেই মন্তব্য করতেন যে বাংলা সাহিত্যের আন্দোলন কি না শুরু করা হল ইংরেজি ভাষায় ।


প্রথম ইশতাহারটিতে আগের প্রজন্মের চারজন কবির নাম থাকায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় ক্ষুন্ন হয়েছিলেন বলে ডিসেম্বরে শেষ প্যারা পরিবর্তন করে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল । ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে, অংশগ্রহণকারীদের নামসহ এই ইশতাহারটি আরেকবার বেরোয় । ১৯৬২ সালের শেষাশেষি ও ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে । দাদার বন্ধু উৎপলকুমার বসু , বিনয় মজুমদার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যোগ দেন । আমার বন্ধু সুবিমল বসাক , অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় যোগ দেন । সুবিমল বসাকের বন্ধু ফালগুনী রায়, ত্রিদিব মিত্রআলো মিত্র যোগ দেন । আলো ছিলেন হাংরি আন্দোলনে একমাত্র মহিলা সদস্য। দেবী রায়ের বন্ধু প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ যোগ দেন । তখনকার দিনে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের ওপর পুলিশ নজর রাখত । দেবী রায় লক্ষ করেননি যে পুলিশের দুজন ইনফর্মার -- পবিত্র বল্লভসমীর বসু -- হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বইপত্র, পত্রিকা, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজার পুলিশের প্রেস সেকশানে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছে ।

এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রতিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈশাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালা বদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কথন-ভাঁড়ারের, পার্ধক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের , তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের । তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে । হাংরি আন্দোলনকারীঔরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধঃস্তরীয় বাক-বৈশিষ্টের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহিনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটক্রিয়ার তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খণ্ডবাক্যের তহবিল, তড়িত ব্যঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্য-নোঙরের তহবিল, শীৎকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিচ্ছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যবদলের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।

ইতোপূর্বে ইয়ংবেঙ্গলের সাংস্কৃতিক উথাল-পাথাল ঘটে থাকলেও, বাংলা শিল্প-সাহিত্যে আগাম ঘোষণা করে, ইশতাহার প্রকাশ করে, কোনো আন্দোলন হয়নি। সাহিত্য এবং ছবি আঁকাকে একই ভাবনা-ফ্রেমে আনার প্রয়াস, পারিবারিক স্তরে হয়ে থাকলেও, সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে হয়নি । ফলত দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি পত্রিকায় আমাদের সম্পর্কে বানানো খবর পরিবেশিত হওয়া আরম্ভ হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ইশতাহার নিয়ে প্রধান সম্পাদকীয় বেরোলো যুগান্তর  দৈনিকে । আমার আর দেবী রায়ের কার্টুন প্রকাশিত হল  দি স্টেটসম্যান, জলসাআনন্দবাজার  পত্রিকায় । হেডলাইন হল ব্লিৎস  পত্রিকায় । সুবিমল বসাকের প্রভাবে হিন্দি ভাষায় রাজকমল চৌধুরী ও নেপালি ভাষায় পারিজাত হাংরি আন্দোলনের প্রসার ঘটালেন। আসামে ছড়িয়ে পড়ল পাঁক ঘেঁটে পাতালে পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে । ছড়িয়ে পড়ল বগুড়ার বিপ্রতীক  এবং ঢাকার স্বাক্ষর  ও কন্ঠস্বর  পত্রিকাগুলির সদস্যদের মাঝে, এবং মহারাষ্ট্রের অসো পত্রিকার সদস্যদের ভেতর । ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীরা, যাঁরা নিজেদের নাম দিয়েছিলেন স্যাড জেনারেশান,   (বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার প্রমুখ ) জানতেন না যে আমি কেন প্রথম দিকের বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে প্রকাশ করেছিলুম। ফলে তাঁরাও আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ইংরেজিতে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে।


যার যেমন ইচ্ছা লেখালিখির দরুণ হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠবস্তুতে যে অবাধ ডিক্যাননাইজেশান, আঙ্গিকমুক্তি, যুক্তিভঙ্গ, ডিন্যারেটিভাইজেশান, অনির্ণেয়তা, মুক্ত-সমাপ্তি ইত্যাদির সূত্রপাত ঘটে, যে, যাথার্থ্য, সার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন উথ্থাপন করতে থাকেন তখনকার বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, যাঁরা বিবিধতাকে মনে করেছিলেন বিশৃঙ্খলা, সমরূপ হবার অস্বীকৃতিকে মনে করেছিলেন অন্তর্ঘাত, সন্দেহপ্রবণতাকে মনে করেছিলেন অক্ষমতা, ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্রের বিরোধিতাকে মনে করেছিলেন অসামাজিক, ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতিরোধকে মনে করেছিলেন সত্যের খেলাপ । তাঁদের ভাবনার বিরোধিতা মানেই যেন অসত্য, প্রতিবাদের যন্ত্রানুষঙ্গ যেন সাহিত্যসম্পর্কহীন । মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার বিরোধিতা, তাই তাঁরা তার যে-কোনো আদল ও আদরা কে হেয় বলে মনে করেছিলেন, কেননা প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে মতবিরোধিতা অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায়, বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে বলে অনুমান করে নেয়া হয়; তা যদি সাহিত্যকৃতি হয় তাহলে সাহিত্যিক মননবিশ্বে, যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হয় তাহলে রাষ্ট্রের অবয়বে । এখানে বলা দরকার যে পশ্চিমবাংলায় তখন রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেনি । তখনকার প্রতিবিম্বিত বিদ্যায়তনিক ভাবাদর্শে, অতয়েব, যারা মতবিরোধের দ্বারা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছিল, অর্থাৎ হাংরি আন্দোলনকারীরা, তারা অন্য রকম, তারা অপর, তারা প্রান্তিক, তারা অনৈতিক, তারা অজ্ঞান, তারা সত্যের মালিকানার অযোগ্য । বলাবাহুল্য যে, ক্ষমতার ও সত্যের অমনতর পার্থক্যহীন পরিসরে যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের কব্জায় সত্যের প্রভূত্ব । অজ্ঞানের চিন্তাভাবনাকে মেরামত করার দায়, ওই তর্কে, সুতরাং, সত্য-মালিকের। এই কারণেই নতুন বামপন্থী সরকার আসার পরও হাংরি আন্দোলনকারীরা 'অপর' থেকে গিয়েছিল, মসনদ-বিরোধী থেকে গিয়েছিল। তরুন ও বৃদ্ধ কবি-লেখকরা যখন হু-হু করে বামপন্থী মসনদের ধামাধরা হয়ে পড়েছিল, হাংরি আন্দোলনকারীরা নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখে ব্যবস্হাটির আলোচনা করেছেন। আমি আমার দুটি প্রবন্ধে পশ্চিমবাংলার বামপন্থী অসুখের কারণ আলোচনা করেছিলুম: তা হল, পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন এবং উত্তরদার্শনিকতা


প্রাগুক্ত মেরামতির কাজে নেমে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি আন্দোলনের তুলনা করতে চাইছিলেন পাঁচের দশকে ঘটে যাওয়া দুটি পাশ্চাত্য আন্দোলনের সঙ্গে । ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও আমেরিকার বিট জেনারেশনের সঙ্গে। তিনটি বিভিন্ন দেশের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতা-নকশা, তথা ব্যক্তি-প্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো তাঁরা মনে করেছিলেন অভিন্ন । আমার মনে হয় বিদ্যায়তনিক ভাবনার প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে সীমিত ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞতা; অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন। যার দরুণ সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে । যে-সমস্ত উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের প্রয়াস তাঁরা করতেন না, এখনও অনেকে করেন না, যদিও হাংরি আন্দোলন নিয়ে কয়েকটি এম ফিল ও পিএচ ডি গবেষণা হয়েছে । প্রতিস্ব-বিশেষের পাঠবস্তু কেন অমন চেহারায় গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্ব-পীড়ন ঘটাচ্ছে তার চাপে পাঠবস্তু গঠনে মনস্তাত্বিক ও ভাষানকশা কীভাবে ও কেন পাল্টাচ্ছে, আর তাদের আখ্যানঝোঁকের ফলশ্রুতিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার বদলে, তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোলাগা ( ফিল গুড ) নামক সাবজেকটিভ খপ্পরে পড়ে পাঠক-সাধারণকে সেই ফাঁদে টানতে চাইতেন । যে-কোনও পাঠবস্তু একটি স্হানিক কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল। কৌমনিরপেক্ষ পাঠবস্তু অসম্ভব ।


কেবল উপরোক্ত দুটি পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ঘটনা নয়, ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে যে আন্দোলনগুলো ঘটেছিল, যেমন নিমসাহিত্য, শ্রুতি, শাস্ত্রবিরোধী এবং ধ্বংসকালীন, তাদের সঙ্গেও হাংরি আন্দোলনের জ্ঞান পরিমণ্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্নক্রিয়া, অভিজ্ঞতাবিন্যাস, চিন্তার আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষনী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক-নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্হাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্ণাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্ক-বিন্যাসের অনুষঙ্গ, অবিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়ীতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্হানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্ণায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্ধনা, দেশজ-অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সথত্রায়ন-প্রকরণ, প্রেক্ষাবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্টী পীড়াপূঞ্জ, ইত্যাদি ব্যাপারে গভীর ও অসেতধসম্ভব পার্ধক্য ছিল । ষাটের দশকের ওই চারটি আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি প্রতিসন্দর্ভের যে মিল ছিল তা হল এই পাঁচটি আন্দোলনই লেখক-প্রতিস্ব থেকে রোশনাইকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পাঠবস্তুর ওপর। অর্থাৎ লেখকের কেরামতি বিচার্য নয়; যা বিচার্য তা হল পাঠবস্তুটির খুঁটিনাটি । লেখকের বদলে পাঠবস্তু যে গুরুত্বপূর্ণ, এই সনাতন ভারতীয়তা, মহাভারতরামায়ণ পাঠবস্তু দুটির দ্বারা প্রমাণিত ।

অনুশাসন-মুক্তির ফলে, লিটল ম্যাগাজিনের নামকরণের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল হাংরি আন্দোলন, যে. তারপর থেকে পত্রিকার নাম রাখার ঐতিহ্য একেবারে বদলে গেল। কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস, শতভিষা, উত্তরসূরী, অগ্রণী ইত্যাদি থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের পত্রিকার নাম রাখলেন জেব্রা, ফুঃ, উন্মার্গ, ওয়েস্টপেপার, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ইত্যাদি।বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকেও সমীর রায়চৌধুরী তাঁর পত্রিকার নাম রাখলেন হাওয়া৪৯ । অবশ্য সাহিত্য-শিল্পকে উন্মার্গ আখ্যাটি জীবনানন্দ দাশ বহু পূর্বে দিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও হাংরি আন্দোলনের সময় পর্যন্ত তিনি তেমন প্রতিষ্ঠা পাননি। জেব্রা নামকরণটি ছিল পাঠকের জন্যে নিশ্চিন্তে রাস্তা পার হয়ে হাংরি পাঠবস্তুর দিকে এগিয়ে আসার আহ্বান । হাংরি আন্দোলন  সংঘটিত হবার আগে পূর্ব-প্রজন্মের ওই পত্রিকাগুলোর নামকরণেই যে কেবল এলিটিজম ছিল তা নয়, সে-সব পত্রিকাগুলোর একটি সম্পাদকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল । বনেদিয়ানার মূল্যবোধ প্রয়োগ করে একে-তাকে বাদ দেয়া বা ছাঁটাই করা, যে-কারণে নিম্নবর্ণের লেখকের পাঠবস্তু সেগুলোয় অনুপস্হিত, বিশেষ করে কবিতা । আসলে কোন-কোন রচনাকে টাইমলেস  বলা হবে সে জ্ঞানটুকু ওই মূল্যবোধের ধারক-বাহকরা মনে করতেন তাঁদের কুক্ষিগত, কেননা সময় তো তাঁদের চোখে একরৈখিক, যার একেবারে আগায় আছেন কেবল তাঁরা নিজে। এখানে উল্লেখ্য, হাংরি আন্দোলনের আগে পর্যন্ত কাজি নজরুল ইসলামজসীমুদ্দিনকেও 'অপর' করে রাখা হয়েছিল।


'টাইমলেস' কাজের উদ্বেগ থেকে পয়দা হয়ছিল 'আর্ট ফর আর্ট সেক' ভাবকল্পটি, যা উপনিবেশগুলোয় চারিয়ে দিয়ে মোক্ষম চাল দিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ। এই ভাবক্লপটির দ্বারা কালো, বাদামি, হলদে চামড়ার মানুষদের বহুকাল পর্যন্ত এমন সন্মোহিত করে রেখেছিল সাম্রাজ্যবাদী নন্দনভাবনা যাতে সাহিত্য-শিল্প হয়ে যায় উদ্দেশ্যহীন ও সমাজমুক্ত, যাতে পাঠবস্তু হয়ে যায় বার্তাবর্জিত, যাতে সন্দর্ভের শাষক-বিরোধী অন্তর্ঘাতী ক্ষমতা লুপ্ত হয়, এবং তা হয়ে যায় জনসংযোগহীন । হাংরি বুলেটিন যেহেতু প্রকাশিত হতো হ্যান্ডবিলের মতন ফালিকাগজে, তা পরের দিনই সমাজ থেকে হারিয়ে যেত । নব্বইটির বেশি বুলেটিন চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে । লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির পক্ষেও কয়েকটির বেশি বুলেটিন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।

তিন
যে-কোনো আন্দোলনের জন্ম হয় কোনো না কোনো আধিপত্যপ্রণালীর বিরুদ্ধে । তা সে রাজনৈতিক আধিপত্য হোক বা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি আধিপত্য হোক না কেন। আন্দোলন-বিশেষের উদ্দেশ্য, অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্খা, গন্তব্য হল সেই প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা । হাংরি আন্দোলন কাউকে বাদ দেবার প্রকল্প ছিল না, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁকে বাদ দেবার জন্যেই এই আন্দোলন। তাঁর ধারণা ভুল ছিল। যে-কোনো কবি বা লেখক, ওই আন্দোলনের সময়ে যিনি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে করেছেন, তাঁর খুল্লমখুল্লা স্বাধীনতা ছিল হাংরি বুলেটিন বের করার । বুলেটিনগুলোর প্রকাশকদের নাম-ঠিকানা দেখলেই স্পষ্ট হবে ( অন্তত যে কয়টির খোঁজ মিলেছে তাদের ক্ষেত্রেও ) যে, তা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নজন কতৃক ১৯৬৩-র শেষ দিক থেকে ১৯৬৪ এর প্রথম দিকে প্রকাশিত । ছাপার খরচ অবশ্য আমি বা দাদা যোগাতাম , কেননা, অধিকাংশ আন্দোলনকারীদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসুও নিজের খরচে বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ হাংরি বুলেটিন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না । এই বোধের মধ্যে ছিল পূর্বতন সন্দর্ভগুলোর মনোবীজে লুকিয়ে-থাকা সত্বাধিকার-বোধকে ভেঙে ফেলার প্রতর্ক । সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয়রা আসার আগে বঙ্গদেশে  পারসোনাল পজেশান  ছিল, কিন্তু প্রায়ভেট প্রপার্টি  ছিল না । ইউরোপীয়রা বাঙালিকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, এবং তা করার পরই ব্যক্তিমানুষ প্রকৃতির মালিকানা দাবি করার যোগ্য মনে করা আরম্ভ করেন নিজেকে।


হাংরি আন্দোলনের কোনো হেডকোয়ার্টার, হাইকমাণ্ড, গভর্নিং কাউন্সিল বা সম্পাদকের দপতর ধরণের ক্ষঞতাকেন্দ্র ছিল না, যেমন ছিল কবিতা, ধ্রুপদী, কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকার ক্ষেত্রে, যার সম্পদক বাড়ি বদল করলে পত্রিকার ক্ষমতাকেন্দ্র সেই বাড়িতে চলে যেত। হাংরি আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে প্রতিসন্দর্ভকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল প্রান্তবর্তী এলাকায় , যে কারণে কেবল বহির্বঙ্গের বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক ছাড়াও তা হিন্দি, উর্দু, নেপালি, অসমীয়া মরাঙী ইত্যাদি ভাষায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল । এখনও মাঝে-মথভে কিশোর-তরুণরা এখাক-সেখান থেকে নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে গর্বিত হন, যখন কিনা আন্দোলনটি কয়েক দশক আগে, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত-অর্থে ফুরিয়ে গেছে । ১৯৬৫ সালের মে মাসে ব্যাংকশাল কোর্টে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন অংশগ্রহনকারী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা সই করে সম্বন্ধ ত্যাগ করেন এবং হাংরি আন্দোলন মকদ্দমায় রাজসাক্ষীরূপে কাঠগড়ায় অবতীর্ণ হন ।

হাংরি আন্দোলনের সময়ে সুবিমল বসাক, হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সঙ্গে, একটি সাইক্লোস্টাইল-করা ত্রিভাষিক  (বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি )  বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, তদানীন্তন সাহিত্যিক সন্দ্যফের প্রেক্ষিতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভ যে কাজ উপস্হাপন করতে চাই্ছে তা স্পষ্ট করার জন্যে । তাতে দেয়া তালিকাটি থেকে আন্দোলনের অভিমুখের কিছুটা হদিশ মিলবে :

প্রথাগত সাহিত্য সন্দর্ভ
প্রাতিষ্ঠানিক
শাসক সম্প্রদায় (টিরানি)
ভেতরের লোক ( অন্দরুনি)
এলিটেতর সংস্কৃতি ( ঢাকোসলা )
তৃপ্ত
আসঞ্জনশীল
লোকদেখানো ( দিখাওয়া )
জ্ঞাত যৌনতা (পরিচিত )
সিশিয়ালিস্ট
প্রেমিক (দুলারা )
একসট্যাসি
নিশ্চল ( আনমুভড )
ঘৃণার কামোফ্লাজ
আর্ট ( ফিল্ম )
শিল্প
রবীন্দ্রসঙ্গীত ( সুগমসঙ্গীত )
স্বপ্ন ( ড্রিম )
শিষ্ট ভাষা ( টিউটর্ড )
রিদিমড ( দায়মুক্ত )
ফ্রেমের মধ্যে
কনফরমিস্ট ( অনুগত )
উদাসীন ( ইনডিফারেন্ট )
মেইনস্ট্রিম ( মূলস্রোত )
কৌতুহল
আনন্দ ( এন্ডোক্রিন )
পরিণতি অবশ্যম্ভাবী
সমাপ্তি প্রতিমা ( আনুষ্ঠানিক )
ক্ষমতাকেন্দ্রিক ( সিংহাসন )
মনোহরণকারী ( এনটারটেইনার )
আত্মপক্ষ সমর্থন
আমি কেমন আছি ( একপেশে )
প্রতিসম
ছন্দের একাউন্ট্যান্ট
কবিতা নিখুঁত করতে কবিতা
রিভাইজ
কল্পনার খেলা


হাংরি প্রতিসন্দর্ভ
প্রতিষ্ঠানবিরোধী
শাসকবিরোধী ( প্রটেস্টার )
বহিরাগত ( হামলাবোল )
জনসংস্কৃতি
অতৃপ্ত
খাপছাড়া (ব্রিটল)ছামড়া ছাড়ানো ( র বোন )
অজ্ঞাত যৌনতা ( অপরিচিত )
সোশিয়েবল
শোককারী ( মোর্নার )
অ্যাগনি
তোলপাড় ( টার্বুলেন্ট )
খাঁটি ঘৃণা
জনগণ ( সিনেমা )
জীবনসমগ্র
যে কোনো গান
দুঃস্বপ্ন ( নাইটমেয়ার )
গণভাষা ( গাট ল্যাংগুয়েজ )
আনরিডিমড (দায়বদ্ধ )
ফ্রেমহীন (কনটেসটেটরি )
ডিসিডেন্ট ( ভিন্নমতাবলম্বী )
এথিকস-সংক্রান্ত
ওয়াটারশেড ( জলবিভাজিকা )
উদ্বেগ
উৎকন্ঠা (অ্যাড্রেনালিন )
উন্মেষের শেষ নাই
সতত সৃজ্যমান ( উৎসব )
ক্ষমতাবিরোধী ( সিংহাসনত্যাগী )
চিন্তাপ্রদানকারী ( থটপ্রোভোকার )
আত্মআক্রমণ
সবাই কেমন আছে
অসম্বদ্ধ ( ট্যাটার্ড )
বেহিসাবি ছন্দ খরচ
জীবনকে প্রতিনিয়ত রিভাইজ
কল্পনার কাজ


১৯৬৩ সালের শেষ দিকে সুবিমল বসাকের আঁকা বেশ কিছু লাইন ড্রইং, যেগুলো ঘন-ঘন হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার দরুণ তাঁকে পরপর দুবার কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের সামনে ঘিরে ধরেছিলেন অগ্রজ বিদ্বজ্জন এবং প্রহারে উদ্যত হলেন, এই অজুহাতে যে ওগুলো অশ্লীল । একই অজুহাতে কফিহাউসের দেয়ালে সাঁটা অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা পোস্টার আমরা যতবার লাগালুম ততবার ছিঁড়ে ফেলে দিলেন সাহিত্যিক-পুলিসগণ । বোঝা যাচ্ছিল যে কলোনিয়াল ইসথেটিক রেঝিমেরচাপ তখনও অপ্রতিরোধ্য । হাংরি আন্দোলনের ১৫ নং বুলেটিন এবং ৬৫ নং বুলেটিন, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারের, যাকে বলা যায় স্নো বোলিং এফেক্ট, আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, এবং আমাদের অজ্ঞাতসারে ক্রুদ্ধ করে তুলছিল তদানীন্তন প্রশাসনের সংরক্ষণশীল কর্তাবাবাদের । আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে ইশতাহার দুটিকে অলমোস্ট প্রফেটিক বলা যায় ।


১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে হাংরি আন্দোলনকারীরা আরেকটি কাজ করলেন , যাকে এখন রাজনৈতিক সক্রিয়তা নামে চিহ্ণিত করলেও, সে-সময়ের সাহিত্যিকরা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে সমাজের নোংরামি ঘাঁটা সাহিত্যিকদের কাজ নয় । যখন রাক্ষস জোকার মিকিমাউস দানভ দেবী-দেবতা জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদির কাগুজে মুখোশে দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন বার্তাটি ছাপিয়ে হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে মুখ্য ও অন্যান্য মন্ত্রীদের, মুখ্য ও অন্যান্য সচিবদের, জেলা শাসকদের, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের , বাণিজ্যিক লেখকদের পাঠানো হল, তখন সমাজের এলিট অধিপতিরা আসরে নামলেন । এ-ব্যাপারে কলকাঠি নাড়লেন একটি পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিক ও তাঁর বশংবদরা, তাঁর বাংলা দৈনিকের বার্তা সম্পাদক , এবং সে-সময়ে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের খোরপোষে প্রতিপালিত একটি ইংরেজি ত্রৈমাসিকের কর্তারা ( মার্কিন অর্থসাহায্য পায় জানাজানি হবার পর পত্রিকাটা বন্ধ হয়ে যায় ) ।


চার
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলুম আমি, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায়চৌধুরী । এই অভিযোগে উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইশ্যু হয়ে থাকলেও, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এই জন্যে চাপানো হয়েছিল যাতে বাড়ি থেকে থানায় এবং থানা থেকে আদালতে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে সবায়ের সামনে দিয়ে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি । অন্তর্ঘাতের অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্ণিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিল, এবং তাদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল তৈরি করে ফেলেছিল, যেগুলো লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স রুমের টেবিলে দেখেছিলুম, যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দপতর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্হ আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারালকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে কয়েক ঘন্টা জেরা করেছিল। কেবল আমাদের দুজনকেই এই বোর্ডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল, কেননা শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু তাঁদের জেরায় জানিয়েছিলেন যে আমরা দুজনেই হাংরি আন্দোলনের দায়িত্বে আছি এবং তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।


অভিযোগটি কোন সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল জানি না । তবে অ্যাডভোকেট জেনারাল মতামত দিলেন যে এরকম আজেবাজে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভোযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে । তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরণের আইন ছিল না; নকশাল আন্দোলনও ঘটেনি। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, এই অভিযোগে যে সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার প্রচণ্ড বৈদ্যূতিক ছুতার কবিতাটি অশ্লীল । আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে । অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন, যার প্রতিলিপি চার্জশিটের সঙ্গে আদালত আমায় দিল। মুচলেকা দুটি এখানে তুলে দেয়া হল:


শৈলেশ্বর ঘোষ:  আমার নাম শেলেশ্বর ঘোষ। আমার জন্ম বগুড়ায় আর বড় হয়েছি বালুরঘাটে । আমি ১৯৫৩ সনে বালুরঘাট হাই ইংলিশ স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি , ১৯৫৫ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে আই.এস.সি., ১৯৫৮ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে বি.এ., আর ১৯৬২ সনে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্পেশাল অনার্স । ১৯৬৩ সনে  সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া নামে একজন তাঁর হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন । তারপরেই আমি হাংরি আন্দোলনের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হই । আমি ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঠ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী এবং উৎপলকুমার বসুকে চিনি গত এপ্রিল মাসে একদিন কলেজসট্রিট কফিহাউসে ম।ব রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, এবং তিনি আমার কাছে কয়েকটা কবিতা চান । তাঁর কাছ থেকে একটা পার্সেল পেয়েছি । আমি মলয় রায়চৌধুরীকে চিনি। তিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনে আমি মোটে দুবার কবিতা লিখেছি। মলয় আমাকে কিছু লিফলেট আর দু-তিনটি পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ তিনি আমাকে দেননি। সাধারণত এই সব কাগজপত্র আমার ঘরেই থাকত । এটুকু ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না। অশ্লীল ভাষায় লেখা আমার আদর্শ নয় । ১৯৬২ থেকে আমি হুগলি জেলার ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল টিচার । মাইনে পাই দু'শ দশ টাকা । বর্তমান সংখ্যা হাংরি বুলেটিনের প্রকাশনার পর, যা কিনা আমার অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়, আমি এই সংস্হার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি । ভবিষ্যতে আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখব না এবং হাংরি পত্রিকায় লিখব না । বর্তমান বুলেটিনটি ছাপিয়েছেন প্রদীপ চৌধুরী । ( স্বাক্ষর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ )


সুভাষ ঘোষ: আমার নাম সুভাষচন্দ্র ঘোষ । গত এক বৎসর যাবত আমি কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে যাতায়াত করছি । সেখানে একদিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় । সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায় ।হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের খবর আমি জানি বটে কিন্তু হাংরি আন্দোলনের যে ঠিক কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না । আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । আমি তা আমার রুম মেট শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে পাই । সে হাংরি বুলেটিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিল। আমি এই ধরণের আন্দোলনের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াতে চাইনি, যা আমার মতে খারাপ । আমি ভাবতে পারি না যে এরকম একটা পত্রিকায় আমার আর্টিকেল 'হাঁসেদের প্রতি' প্রকাশিত হবে । আমি হাংরি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করিনা, আর এই লেখাটা প্রকাশ হবার পর আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি । ( স্বাক্ষর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ )


প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে, তাদের দুমুখো কথাবার্তার কারণে, নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি । তাই আমার বিরুদ্ধে পুলিসের ইনফর্মার দুই ভুয়ো সাক্ষী, সমীর বসু এবং পবিত্র বল্লভকে, উইটনেস বক্সে তোলা হয় , যাদের আমি কখনও দেখিনি, অথচ যারা এমনভাবে সাক্ষ দিয়েছিল যেন আমার সঙ্গে তাদের কতই না আলাপ-পরিচয় । এই দুজন ভুয়ো সাক্ষীর উদ্দেশ্য ছিল আইনের দায়রায় আমাকে অপরাধী প্রমাণ করা । এরা পুলিশের ইনফর্মার ছিল বলে এদের আইন-কানুন সব জানা ছিল। আমার কৌঁসুলিদের জেরায় এরা ভুয়ো প্রমাণ হবার উপক্রম দেখা দিলে প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে উইটনেস বক্সে তোলে , বলাবাহুল্য গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে --- মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের কাছে যে অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর --- শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে ।ম ফলে আমিও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসাবে দাঁড় করাই জ্যোতির্ময় দত্ত ( বুদ্ধদেব বসুর জামাই ), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল ও মনোবিদ সত্রাজিৎ দত্তকে ( কবি অজিত দত্তের ছেলে )। শক্তি এবং সুনীল, দুই বন্ধু, একটি মকদ্দমায় পরস্পরের বিরুদ্ধে, পাঁচ দশক পর ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে ; তখন কিন্তু তেমন ছিল না ।


আমি আরও অনেক সাহিত্যিককে অনুরোধ করেছিলুম কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেননি । সে-সময়ে কিউবায় কোনো কবির ফুসকুড়ি হলে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মিত্র,  পদ্মশ্রী শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, অমিয় দেব, পবিত্র সরকার, দেবেশ রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ প্রতিবাদের স্রোত বইয়ে দিতেন । কিন্তু আমার সমর্থনে দীপক মজুমদার তাঁদের কাছে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে গেলে কেউই আমাকে সমর্থন করতে রাজি হননি। কোনো, লেখক বা কবি আদালতে আসতেন না । কফিহাউসে প্রায় সবাই ভয়ে কথা বলতেন না আমার সঙ্গে । শঙ্খ ঘোষ মশায় এখন অনেক বড়-বড় কথা বলেন, অথচ সেসময়ে তিনি ঘোর হাংরি বিরোধী ছিলেন ।


পাঁচ
সবায়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম ড্রামা । অবশ্য তখন আমার থাকার, খাওয়ার, কোর্টে পৌঁছোবার প্রচুর সমস্যা ছিল, কেননা কলকাতায় থাকার কোনো আস্তানা আমার ছিল না । পর-পর দুদিন ডেট থাকলে কলকাতায় থাকতে হতো শরদ দেওড়া নামে একজন ব্যবসায়ীর বড়বাজারের গদিতে, যিনি হিন্দি 'অনিমা' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন; তাঁর কর্মীরাও ওই গদিতে শুতেন; একটিমাত্র পায়খানা; স্নানের ব্যবস্হা ছিল না । নয়তো বৈঠকখানা পাড়ায় সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানঘরে; উনি দোকান বন্ধ করে দেবার পর; সেখানে পায়খানা-বাথরুম কিছুই ছিল না বলে যেতে হতো শেয়ালদা স্টেশানের টয়লেটে বা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে । কাঁধের ঝোলায় দুটো গামছা রাখতুম, যাতে কোথাও স্নানের সুযোগ না পেলে গঙ্গায় সেরে নেয়া যায়; সূভাগ্যবশত ঘাটগুলো ব্যাংকশাল কোর্টের ও হাইকোর্টের পাশেই । নয়তো আহিরিটোলায় পিসেমশায়ের এক ঘরের শরিকি বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতুম আমার ছয়টি পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে, খাটের তলায় শুয়ে । এক ডেট থেকে আরেক ডেটের মাঝে বেশ কয়েক দিন সময় থাকলে উত্তরপাড়ায় আমাদের সাবর্ণ চৌধুরী বসতবাড়িতর খন্ডহরে গিয়ে থাকতুম, যেখানে বারোটি ঘর, তিনটি সিঁড়ি মিলিয়ে বিশাল এলাকায় ঠাকুমা একাই থাকতেন, হবিষ্য রান্না করে খেতেন ; আমাকে বলতেন বাইরে খেয়ে নিতে । উত্তরপাড়ার খন্ডহর থেকে হেঁটে স্টেশান, ট্রেনে হাওড়া, হেঁটে ব্যাংকশাল কোর্ট । ওই ভাবেই ফেরা। যেদিন সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র বা আমার কাকা-জ্যাঠা-বাবা-দাদা আসতেন, সেদিন খরচের সমস্যা হতো না ।


তেরোটা আদালতঘরের মধ্যে আমার মকদ্দমাটা ছিল নয় নম্বর এজলাসে । বিচারকের মাথার ওপরে হলদে টুনি বালবটা ছাড়া আলোর বালাই ছিলনা জানালাহীন ঘরটায় । অবিরাম ক্যাঁচোর-ক্যাঁচোর শব্দে অবসর নেবার অনুরোধ জানাত দুই ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা । পেশকার গাংগুলিবাবুর অ্যান্টিক টেবিলের লাগোয়া বিচারকের টেবিল, বেশ উঁচু, ঘরের এক থেকে আরেক প্রান্ত, বিচারকের পেছনে দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধীর ফোকলা-হাসি রঙিন ছবি। ইংরেজরা যাবার পর চুনকাম হয়নি ঘরটা । হয়তো ঘরের ঝুলগুলোও তখনকার ।বিচারকের টাবিলের বাইরে, ওনার ডান দিকে, দেয়াল ঘেঁষে, জাল-ঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বিচারাধীনদের জন্যে, যারে ওই খাঁচের পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকতো । খাঁচাটা অত্যান্ত নো২রা । আমি যেহেতু ছিলুম জামিনপ্রাপ্ত, দাঁড়াতুম খাঁচার বাইরে; ঠ্যাঙ ব্যাথা করলে, খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে ।


পেশকার মশায়ের টেবিলের কাছাকাছি থাকত গোটাকতক আস্ত-হাতল , ভাঙা-হাতল আর হাতলহিন চেয়ার, কৌঁসুলিদের জন্যে , একটি চেয়ারের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। ঘরের বাকিটুকুতে ছিল নানা-মাপের আকারের রঙের নড়বড়ে বেঞ্চ আর চেয়ার, পাবলিকের জন্যে, ছারপোকা আর খুদে আরশোলায় গিজগিজে । টিপে-মারা ছারপোকার রক্তে, পানের পিকে, ঘরের দেয়ালময় ক্যালিগ্রাফি । বসার জায়গা ফাঁকা থাকত না । কার মামলা কখন উঠবে ঠিক নেই । ওই সর্বভারতীয় ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে, ছারপোকার দৌরাত্ম্যে, বসে থাকতে পারতুম না বলে সারা আদালত-বাড়ি এদিক-ওদিক র্্যা-ফ্যা করতুম, এ-এজলাস সে-এজলাস চক্কর মারতুম, কৌতুহলোদ্দীপক সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে পড়তুম । আমার কেস ওঠার আগে সিনিয়ার উকিলের মুহুরিবাবু আমায় খুঁজে-পেতে ডেকে নিয়ে যেতেন । মুহুরিবাবু মেদিনীপুরের লোক, পরতেন হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ক্যাম্বিশের জুতো, ছাইরঙা শার্ট । সে শার্টের ঝুল পেছন দিকে হাঁটু পর্যন্ত আর সামনের দিকে কুঁচকি পর্যন্ত । হাতে লম্বালম্বি ভাঁজ-করা ফিকে সবুজ রঙের দশ-বারোটা ব্রিফ, যেগুলো নিয়ে একতলা থেকে তিন তলার ঘরে-ঘরে লাগাতার চরকি-নাচন দিতেন।
আমার সিনিয়ার উকিল ছিলেন ক্রিমিনাল লয়ার চন্ডিচরণ মৈত্র । সাহিত্য সম্পর্কে ওনার কোনো রকম ধারণা ছিল না বলে লেবার কোর্টের সাহিত্যানুরাগী উকিল সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখতে হয়েছিল । সত্যেনবাবু ক্রিমিনাল মামলার বিশেষ-কিছু বুঝতেন না । দুই উকিল দুই বিপরীত মেরুর বলে, পরে বুঝতে পারি, আমার মামলাটা ঠিকমতন লড়তে পারেননি নিম্ন আদালতের এই উকিলদ্বয় । চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড ছিলুম কেস লড়ার সময়ে, তার ওপর কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । খরচ সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল । নয়তো ভালো উকিল দিয়ে মামলাটা ঠিকমতন লড়া যেতে পারত, যা সম্ভব হয়েছিল উচ্চ আদালতে লড়তে গিয়ে ।


আদালত চত্তরটা সবসময় ভিড়ে গিজগিজ করত । ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে, "সাক্ষী চাই? সাক্ষী চাই? এফিডেভিট হবে?" বলে-বলে চেঁচাতো মক্কেল যোগাড়ের ধান্দায় । সাড়া বাড়ি জুড়ে যেখানে-সেখানে টুল পেতে টাইপরাইটারে ফটর-ফটর ত্যারা-বেঁকা টাইপ করায় সদা ব্যস্ত টাইপিস্ট, পাশে দাঁড়িয়ে চোপসানো-মুখ লিটিগ্যান্ট । গেটের ভেতর ঢুকে, কোর্টচত্তরের সর্বত্র, কাগজ, তেলেভাজা, অমলেট, চাউমিন, চা-জলখাবার, ভাতরুটির ঠেক ।  (ব্যাংকশাল কোর্টের আশে-পাশের গলিতে ফুটপাথে ভাতের হোটেলগুলো বেশ সস্তা ; আমার দুপুরের খাওয়াটা এই সব ফুটপাতিয়া হোটেলেই সারতুম।) কোর্টপেপার কেনার দীর্ঘ কিউ। চাপরাশি, আরদালিদের আদালতের কাজে  ইংরেজরা যে-সব বিহারিদের চাকরি দিয়েছিল, তারা চত্তরের খোঁদলগুলো জবরদখল করে সংসার পেতে ফেলেছে ; আদালতবাড়ির পেছনের উঠোনে তাদের পরিবারের সদস্যদের শায়া-ধুতি-শার্ট ইত্যাদি দড়িতে শুকোচ্ছে ।


জেল থেকে খতরনাক আসামিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন একটু সময়ের জন্য চত্তরের ভিড়টা সরে যেত। কয়েদিরা যে-যার এজলাসে সেঁদিয়ে গেলে ভিড় আবার যা-কে সেই। সর্ন্দর্ভ ও প্রতিসন্দর্ভের সামাজিক সংঘাতক্ষেত্র হিসেবে আদালতের মতন সংস্হা আর বোধ হয় নেই ।


সকলের সাক্ষ্য এখানে তুলে দিলে পাঠকের পড়ার ধৈর্য থাকবেনা । আমি দুটি তুলে দিচ্ছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি চব্বিশে জুন ১৯৬৫ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যিনি পাঁচুই নভেম্বর সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁদের সওয়াল-জবাবের সার্টিফায়েড কপিতে বিধৃত ইতিহাস দিয়ে আমি এই রচনার উপসংহার টানি।


শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য:
পেশকার: এই নিন, গীতার ওপর হার হাত রাখুন । বলুন, যা বলব ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: যা বলব, ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না ।
পেশকার: নাম বলুন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।
বিচারক অমল মিত্র : আপনি কী করেন ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: আজ্ঞে, লিখি ।
বিচারক অমল মিত্র: কী কাজ করেন তাই বলুন। হোয়াট ইজ ইয়োর লাইভলিহুড ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: লেখালিখিই করি । এটাই জীবিকা।
পাবলিক প্রসিকিউটার: আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, আপনি তো একজন বি.এ. ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
বিচারক অমল মিত্র: আপনি বি.এ. কি না তাই বলুন। আপনি কি একজন স্নাতক ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: আজ্ঞে না ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি তো প্রথম থেকে হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই না ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ছিলাম।
পাবলিক প্রসিকিউটার: কী ভাবে ছিলেন সেটা ইয়োর অনারকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো ।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: সমীরের ছোট ভাই মলয় ইংরেজ কবি চসার আর জার্মান ফিলোজফার অসওয়াল্ড স্পেংলারের আইডিয়া থেকে একটা নন্দনতত্ব দিয়েছিল । সেই আইডিয়া ফলো করে আমরা কয়েকজন মিলে আন্দোলনটা আরম্ভ করি।
পাবলিক প্রসিকিউটার: আসামি মলয় রায়চৌধুরীকে তাহলে চেনেন ? কবে থেকে চেনেন ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ চিনি । অনেক কাল থেকে ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: কী ভাবে জানাশোনা হল ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ওর বড় ভাই সমীর আমাএ ঘনিষ্ঠ বন্ধু । সমীরের চাইবাসার বাড়িতে থাকার সময়ে আমি প্রচুর লিখতাম । সেই সূত্রে মলয়ের সঙ্গে ওদের পাটনার বাড়িতে পরিচয়।
পাবলিক প্রসিকিউটার: কারা-কারা এই হাংরি জেনারেশন আন্দোলন আরম্ভ করেন ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: মলয় রায়চৌধুরী ওর বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়, উৎপলকুমার বসু আর আমি । ছাপা-টাপার খরচ প্রথম থেকে ওরা দু ভাইই দিয়েছে । পরে আরও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম বলব কি ?
পাবলিক প্রসিকিউটার: তা আপনি যখন পায়োনিয়ারদের একজন, তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখলেন না কেন ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: এমনিই । এখন আমার লেখার কাজ অনেক বেড়ে গেছে ।
বিচারক অমল মিত্র: ইউ মিন দেয়ার ওয়াজ এ ক্ল্যাশ অব ওপিনিয়ন ? নট ক্ল্যাশ অব ইগো আই সাপোজ ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: আজ্ঞে হ্যাঁ । তাছাড়া এখন আর সময় পাই না ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: কত দিন হল আপনি হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত নন ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: প্রায় দেড় বছর ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: দেখুন তো হাংরি জেনারেশনের এই সংখ্যাটা পড়েছেন কি না ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: পড়েছি । কবিতা পেলেই পড়ি ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটা পড়েছেন কি ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, কবিতাটা আমি পড়েছি ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ভালো লাগেনি ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: ভালো লাগেনি বলতে আপনি অবসিন...
ডিফেন্স কাউনসেল: আই অবজেক্ট টু ইট ইয়োর অনার । হি কান্ট আস্ক লিডিং কোয়েশ্চেন্স ইন সাচ আ ওয়ে ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: ওয়েল, আই অ্যাম রিফ্রেজিং দি কোয়েশ্চেন । আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, ভালো লাগেনি বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ভালো লাগেনি মানে জাস্ট ভালো লাগেনি । কোনো-কোনো কবিতা পড়তে ভালো লাগে, আবার কোনো-কোনো কবিতা আমার ভালো লাগে না ।
বিচারক অমল মিত্র: সো দি ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন ওয়াজ বেসড অন লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস । হেয়ার ইউ মিন দি পোয়েম ডিডন্ট অ্যাপিল টু ইয়োর ইসথেটিক সেনসেস ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ইয়েস স্যার ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: দ্যাটস অল।
ডিফেন্স কাউনসেল: ক্রসিং হবে না ।


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য:
পেশকার: এই বইটার ওপর হাত রাখুন এবং বলুন, যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিধ্যা বলব না ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না ।
পেশকার: আপনার নাম ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।
ডিফেন্স কাউনসেল: আপনি কী করেন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় ফিচার লিখি ।
ডিফেন্স কাউনসেল: শিক্ষা ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষায় এম.এ. ।
ডিফেন্স কাউন্সেল: আপনার লেখা কোথায় প্রকাশিত হয় ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: আমি দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, পূর্বাশা এবং আরও অনেক পত্রিকায় লিখি । পূর্বাশা আর প্রকাশিত হয় না । আমার অনেকগুলো বই আছে, তার মধ্যে একটার নাম ' বরণীয় মানুষের স্মরণীয় বিচার' । আমি অনেক কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস লিখেছি ।
ডিফেন্স কাউনসেল: আপনি মলয়ের কবিতাটা পড়েছেন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: হ্যাঁ, অনেকবার ।
বিচারক অমল মিত্র: আরেকবার পড়ুন ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: জোরে-জোরে পড়ব না মনে-মনে ?
বিচারক অমল মিত্র: না-না, মনে-মনে ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : হ্যাঁ, পড়ে নিলুম ।
ডিফেন্স কাউনসেল: পড়ে কি অশ্লীল মনে হচ্ছে ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: কই না তো । আমার তো বেশ ভালো লাগছে পড়ে । বেশ ভালো লিখেছে।
ডিফেন্স কাউনসেল: আমনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: না, তা কেন হবে ? কবিতা পড়লে সেসব হয় না ।
ডিফেন্স কাউনসেল: দ্যাটস অল ইয়োর অনার ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি এই ম্যাগাজিনের বিষয়ে কবে থেকে জানেন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: ওদের আন্দোলন সম্পর্কে আমি প্রথম থেকেই জানি ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি ওই জার্নালে লিখেছেন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: না, লিখিনি কখনও ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি ওরকম কবিতা লেখেন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: পৃথিবীর কোনো দুজন কবি একই রকম লেখেন না, আর একই রকম ভাবেন না ।
পাবলিক প্রসিকিউটার: কবিতাটা কি অবসিন ?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: না । ইট কনটেইনস নো অবসিনিটি । ইট ইজ অ্যান এক্সপ্রেশান অব অ্যান ইমপর্ট্যান্ট পোয়েট ।


ছয়
সরকারি পক্ষের আর আমার পক্ষের সাক্ষ্যাদি চলে ছিল বেশ কিছুদিন। সহজে ডেট পাওয়া যেত না বলে কেসটা বিলম্বিত হয়েছিল । ফলত আমার দুর্ভোগ ও একাকীত্ব। একাকীত্ব এই জন্যে যে রাজসাক্ষী হবার ঘটনা জানাজানি হবার পর এবং আমার বিরুদ্ধে মামলা চলছিল বলে, বন্ধুবান্ধব বলতে হাতেগোনা । একাই কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতুম । ডায়েরি রাখলে নতুন ধরণের লেখা তৈরি করা যেতে পারত । প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবিরা তো আমায় দেখলেই অন্য দিকে মুখ করে দ্রুত হাঁটা দিতেন। কফিহাউসেও আমাকে দেখে মুখ শুকিয়ে যেত অনেকের ।


সাক্ষাদি শেষ হবার পর দু-পক্ষের দীর্ঘ বহস হল একদিন, প্রচুর তর্কাতর্কি হল । আমি খাঁচার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে । রায় দেবার দিন পড়ল ১৯৬৫ সালের আঠাশ ডিসেম্বর । ইতিমধ্যে আমেরিকায় 'টাইম' ম্যাগাজিনে সংবাদ হয়ে গেছি । 'যুগান্তর' দৈনিকে 'আর মিছিলের শহর নয়' এবং ' যে-ক্ষুধা জঠরের নয়' শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখলেন কৃষ্ণ ধর । 'যুগান্তর' দৈনিকে সুফী এবং ' আনন্দবাজার' পত্রিকায় চণ্ডী লাহিড়ী কার্টুন আঁকলেন আমায় নিয়ে । 'দি স্টেটসম্যান' দৈনিকে হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে সমাজ-বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হল । সমর সেন সম্পাদিত 'নাউ' পত্রিকায় পরপর দুবার লেখা হল আমার সমর্থনে । হিন্দিতে 'ধর্মযুগ', 'দিনমান', 'সন্মার্গ', 'সাপ্তাহিক হিন্দুস্তান', 'জনসত্তা' পত্রিকায় উপর্যুপরি ফোটো ইত্যাদিসহ লিখলেন ধর্মবীর ভারতী, এস. এইচ. বাৎসায়ন অজ্ঞেয়, ফণীশ্বরনাথ রেণু, কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস, ধুমিল, রমেশ বকশি প্রমুখ । কালিকটের মালায়ালি পত্রিকা 'যুগপ্রভাত' হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করল ।


বুয়েনার্স আয়ার্স থেকে 'প্যানারোমা' পত্রিকার সাংবাদিক আমার মকদ্দমা কভার করল । পাটানার দৈনিক 'দি সার্চলাইট' প্রকাশ করল বিশেষ ক্রোড়পত্র । বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করল জার্মানির 'ক্ল্যাক্টোভিডসেডস্টিন' পত্রিকা; নিউ ইয়র্কের 'কুলচুর' পত্রিকা ছাপালো সব কয়টি ইংরেজি ম্যানিফেস্টো-বুলেটিন। হাংরি আন্দোলোনকারীদের ফোটো, ড্রইং, রচনার অনুবাদ নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল 'সল্টেড ফেদার্স', 'ট্রেস', 'ইনট্রেপিদ', 'সিটি লাইটস জার্নাল', 'সানফ্রানসিসকো আর্থকোয়েক', 'রেমপার্টস', 'ইমেজো', 'হোয়্যার' ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিন । সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্কের 'এভারগ্রিন রিভিউ', আর্জেনটিনার 'এল কর্নো এমপ্লুমাদো' এবং মেকসিকোর 'এল রেহিলেতে' পত্রিকায় । নেট সার্চ করলে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত এই পত্রিকাগুলোর হদিস পাওয়া যাবে।পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায়, টিটকিরি মারা ছাড়া আর কিছু করেননি বাঙালি সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবিরা ।


ভুয়ো সাক্ষী, রাজ সাক্ষী আর সরকারি সাক্ষীদের বক্তব্যকে যথার্থ মনে করে আমার পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যকে নাকচ করে দিলেন ফৌজদারি আদালতের বিচারক । দুশো টাকা জরিমানা ( যা ছিল ওই ধারায় সে-সময়ে সর্বোচ্চ ) অনাদায়ে আক মাসের কারাদণ্ড ধার্য করলেন তিনি । সাজা হবার ফলে, যাওবা কয়েকজন লেখক-কবি অন্তত কয়েকটা বাক্য আদান প্রদান করতেন, তাঁরাও দূরত্ব বজায় রাখা আরম্ভ করলেন। রাজ সাক্ষীরা, তাঁদের কুকর্ম ধরা পড়ায়, কফিহাইউসও এড়িয়ে যেতেন । আমার সময় কাটতে লাগল হাইকোর্টে অ্যাপিল করার অ্যাডভোকেট খোঁজা, নিম্ন আদালত থেকে সার্টিফায়েড কপি বের করায়। খাওয়া-দাওয়া ফুটপাতিয়া হোটেলে । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র বা ফালগুনী রায় অনেক সময়ে কলেজ স্ট্রিট বা শ্যামবাজারে পাইস হোটেলে নিয়ে গিয়ে মাছ-মাংস খাওয়াতেন ।


আমি হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করার জন্যে আইনজীবিদের খোঁজে বেরিয়ে দেখলুম যে খ্যাতিমান কৌঁসুলিদের এক দিনের বহসের ফি প্রায় লক্ষ টাকা; অনেকে প্রতি ঘন্টা হিসেবে চার্জ করেন ; তাঁরা ডজনখানেক সহায়ক উকিল দুপাশে দাঁড় করিয়ে বহস করেন । হাইকোর্টে ঘোরাঘুরি করে বুঝলুম এনারা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন সদ্য লন্ডন ফেরত ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে, যিনি লন্ডনে থাকতে হাংরি আন্দোলোনের কথা শুনেছিলেন, পড়েছিলেন, এবং আমার মকদ্দমা সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন । তাঁর সৌজন্যে আমি তখনকার বিখ্যাত আইনজীবি মৃগেন সেন  ও তাঁর তিনজন সহায়ককে পেলুম । তাঁর ফিস দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না । তবু, এই ধরণের তিনি কখনও লড়েননি বলে রাজি হলেন । নিজের সহায়কদের নিয়ে তিনি কয়েকদিন বসে তর্কের স্ট্র্যাটেজি কষলেন। ১৯৬৭ সালের ছাব্বিশে জুলাই আমার রিভিশন পিটিশানের শুনানি হল । নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দিলেন বিচারপতি টি.পি. মুখার্জি । টোকেন ফিস ইন্সটলমেন্টে দেবার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন করুণাশঙ্কর রায় ।


হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গিয়েছে সেই ষাটের দশকে । এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা । সমীর চৌধুরী নামে আনন্দবাজার পত্রিকার এক কর্মী ( আমার দাদার নামের সঙ্গে মিলটা কাজে লাগিয়ে । 'হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন' নামে একটা বই বের করেছেন। তাতা অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না ।এই সংকলনে আমার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের রচনা নেই! সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাথ্যায়-এর আঁকা ড্রইং নেই । একটাও ম্যানিফেস্টো নেই । বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ ।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
১) মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাসমগ্র । আবিষ্কার প্রকাশনী, ১২ এ বাঁশদ্রোণিঘাট রোড, কলকাতা ৭০০ ০৭০,
ফোন: ০৩৩-২৪১০-৫১৩২, মোবাইল: ৯৮৩০৩৩১০৯২
২) মলয় রায়চৌধুরীর প্রবন্ধসমগ্র । আবিষ্কার প্রকাশনী ।
৩) মলয় রায়চৌধুরীর 'আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা' । কবিতা পাক্ষিক, ৪৯ পটলডাঙা স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০৯,
ফোন: ০৩৩-২৪৫৫-৬৩২৫, মোবাইল: ৯৮৩১১০৪২৭৯

৪) মলয় রায়চৌধুরীর তিনটি উপন্যাস । তেহাই প্রকাশনী,  এবি ২৯ দেশবন্ধুনগর, বাগুইআটি , কলকাতা ৭০০০৫৯,
মোবাইল: ৯৮৩১৫৭৯৮৮২, ৯০৫১৩৬৮৯০৬

৫) মলয় রায়চৌধুরীর বাল্যস্মৃতি ছোটোলোকের ছোটোবেলা । চর্চাপদ পাবলিকেশান, ১৩বি রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা ৭০০০১২, ফোন: ০৩৩-২২৫৭-৩১৪৪, মোবাইল: ৯৮৩০৩৭৯৮৪২

৬) মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ছোটগল্প । কোয়ার্ক পাবলিশার্স, ১০/৯ সিদ্ধিনাথ চ্যাটার্জি রোড, কলকাতা ৭০০০৩৪,
মোবাইল: ৯৮৩০০১৫৫২৫

৭) মলয় রায়চৌধুরী লিখিত রেঁবোর জীবন ও কবিতা । কবিতীর্থ প্রকাশনী , ৫০/৩ কবিতীর্থ সরণি, কলকাতা ৭০০০২৩, ফোন: ০৩৩-২৪০১-০৯৫৪, মোবাইল: ৯২৩১৮৫৯৯৮৮

৮) মলয় রায়চৌধুরী লিখিত শার্ল বদল্যারের জীবন ও কবিতা । কবিতীর্থ প্রকাশনী ।

৯) মলয় রায়চৌধুরী অনুদিত অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর ক্যাডিশ । কবিতীর্থ প্রকাশনী ।

১০) মলয় রায়চৌধুরীর নাটকসমগ্র । কবিতীর্থ প্রকাশনী ।
১১) মলয় রায়চৌধুরীর বাল্যস্মৃতি এই অধম ওই অধম । কবিতীর্থ প্রকাশনী ।



























































































3 comments:

  1. পড়লাম, অনেক কিছু জানতে পারলাম ,আরও পড়ব । সত্যই তো শিল্প নামে কোন অলীক কাণ্ড নেই কোথাও ... ওটা আর কোন দৈব সূত্রে পাওয়া সাজানো গুছানো বিলাস ব্যাপার নয় , জীবন যাপনের সত্য প্রকাশই হল কবিতা !!!!!!

    ReplyDelete
  2. প্রথম থেকে পুরোটাই পড়লাম। বইয়ে পড়েছিলাম হাংরি আন্দোলনের কথা, মুল নায়কের সাথে পরিচয় হবে তা কল্পনাতীত ছিলো। আরো পড়তে চাই, আরও জানতে চাই।

    ReplyDelete
  3. ২০১৪ সালে প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত চন্দ্রগ্রহণ পত্রিকাটিতে প্রথম হাংরি আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত পড়েছি।সভ্যতার সত্যটুকু গভীরভাবে উঠে এসেছে সেখানে।খুব আগ্রহ ছিলো,আজ আর একটু কাছের থেকে অনুভব করলরম।জীবনকে জানার একটা অদম্য বাসনা সবারই থাকে।কিন্তু তার পথটা,দীর্ঘ্য ও ধাপে ধাপে, এখানে স্বার্থহীন টিকে থাকাটাই সংগ্রাম,নিজের সাথে।তবু টেনে রাখে আমাকে

    ReplyDelete