Saturday

হাংরি, অ্যাংরি, বিট আন্দোলনের পার্থক্য

 

হাংরি আন্দোলন, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান, বিট জেনারেশান: আন্দোলনগুলোর পার্থক্য : মলয় রায়চৌধুরী


১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনের প্রথম ইশতাহারটি প্রকাশিত হওয়ামাত্র দর্পণ, জনতা, জলসা ইত্যাদি হালকামেধা পত্রিকাসহ অমৃত, দৈনিক বসুমতী, দৈনিক যুগান্তর-এর মতন বহুগ্রাহ্য পত্রিকার পাশাপাশি বাংলা ভাষাসাহিত্যের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক হাংরি, অ্যাংরি এবং বিট, তিনটি বিভিন্ন দেশের ঘটনাকে এমনভাবে উল্লেখ ও উপস্হাপন করতেন, যেন এই তিনটি একই প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, এবং তিনটি দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো, কৌমসমাজের ক্ষমতানকশা, তথা ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মিতির উপাদানগুলো অভিন্ন । পত্র পত্রিকার লেখক ও সাংবাদিকরা ক্রেতা সুড়সুড়ির কথা মাথায় রেখে এই ধরণের মন্তব্য করতেন, কেননা অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বিটদের সম্পর্কে বহুবিধ গুলগল্প ততদিনে পৃথিবীময় চারিয়ে দিতে সফল হয়েছিল ইউরোপ আমেরিকার ক্ষমতার মিডিয়ে, যখন কিনা বঙ্গসংস্কৃতির মাঝে আচমকা এসে-পড়া হাংরি আন্দোলনকে মূর্ততা দেবার জন্য বাঙালির ইতিহাস থেকে কোনো সমান্তরাল ঘটনা তাঁরা দ্রুত খুঁজে পাননি ।


প্রশ্ন হল যে বাংলা ভাষাসাহিত্যের বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরা, কয়েকজন তখনই পিএচ ডি করে ফেলেছিলেন, তাঁরা কেন হাংরি, অ্যাংরি, বিট কাউন্টার ডিসকোর্সগুলোকে একই জ্ঞান পরিমণ্ডল, দর্শন-পরিসর, প্রতিপ্রশ্ন-প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা-বিন্যাস, চিন্তার আকরণ, প্রতীতি, বিশ্লেষণী আকল্প, প্রতিবেদনের সীমান্ত, প্রকল্পনার মনোবীজ, বয়ন-পরাবয়ন, ভাষা-পরাভাষা, জগৎ-পরাজগৎ, বাচনিক নির্মিতি, সত্তাজিজ্ঞাসা, উপস্হাপনার ব্যঞ্জনা, অপরত্ববোধ, চিহ্ণাদির অন্তর্বয়ন, মানবিক সম্পর্কবিন্যাসের অনুষঙ্গ, অভিধাবলীর তাৎপর্য, উপলব্ধির উপকরণ, স্বভাবাতিযায়িতা, প্রতিস্পর্ধা, কৌমসমাজের অর্গল, গোষ্ঠীক্রিয়ার অর্থবহতা, প্রতাপবিরোধী অবস্হানের মাত্রা, প্রতিদিনের বাস্তব, প্রান্তিকায়নের স্বাতন্ত্র্য, বিকল্প অবলম্বন সন্ধান, চিহ্ণায়নের অন্তর্ঘাত, লেখন-গ্রন্হনা, দেশজ অধিবাস্তব, অভিজ্ঞতার সূত্রায়ন-প্রকরণ, প্রেক্ষাবিন্দুর সমন্বয়, সমষ্টি পীড়াপূঞ্জ, ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত করে ফেললেন ? যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে করছিলেন, তাঁদের কথা আমি বাদ দিচ্ছি । তাঁরা ইচ্ছে করে গুলিয়ে দিচ্ছিলেন ।


সবাই যে হাংরি, অ্যাংরি, বিট সাহিত্যকৃতি ও সমাজব্যবস্হার পাঠকৃতিকে ইচ্ছে করে একই কাউন্টারডিসকোর্স প্রতিপন্ন করতে চাইছিলেন, তা কিন্তু নয় । অনেকে অমনটা অনুমান করে নিচ্ছিলেন । যাঁরা হাংরি, অ্যাংরি, বিট টেক্টগুলোকে একই জিনিস ভেবেছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার প্রধান অন্তরায় হিসাবে কাজ করেছে সীমিত পরিসরের বিশেষজ্ঞতা ; অর্থাৎ কেবলমাত্র বাংলা ভাষাসাহিত্য বিষয়ক পঠন-পাঠন । যাকে বলা হয় মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ, তা সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে । যার দরুণ ব্যক্তি মানুষের জীবনকে তাঁরা ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সাহিত্যের উপকরণ প্রয়োগ করে । যে সমস্ত উপাদানের সাহায্যে কৌমসমাজটি তার ব্যক্তিদের প্রতিস্ব নির্মাণ করে, সেগুলো ভেবে দেখার ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি । প্রতিস্ব-বিশেষের টেক্সট কেন অমনভাবে দৃষ্টির গোচরে আসছে, টেক্সট-বিশেষের প্রদায়ক গুণনীয়ক কী-কী, পুঁজিপ্রতাপের কৌমকৃৎকৌশল যে প্রতিস্বপীড়ন ঘটাচ্ছে, তার চাপে টেক্সট গঠনে মনস্তাত্বিক ও ভাষাতাত্বিক আদরা  কীভাবে পাল্টাচ্ছে, আর তার আখ্যান-ঝোঁকের ফলশ্রুতিই বা কেন অমনধারা, এগুলো নিয়ে চিন্তা করার বদলে নিজের ভালোলাগা নামক একটি সাবজেকটিভ খপ্পরে তাঁরা নিজেরাই পড়েগিয়েছিলেন । যে-কোনো টেক্সট একটি কৌমসমাজের নিজস্ব ফসল । কৌমনিরপেক্ষ টেক্সট অসম্ভব । যে সমস্ত বিদ্যায়তনিক আলোচক এক নিঃশ্বাসে হাংরি-অ্যাংরি-বিট ডিসকোর্সগুলোকে মগজে পুরে নিয়ে তাদের সমরূপতা দেবার চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা প্রকারান্তরে প্রতিটি টেক্সটকে কৌমনিরপেক্ষ বলে অনুমান করে নিচ্ছিলেন ।


যে বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি, অ্যাংরি, বিট কাউন্টার ডিসকোর্সগুলোকে একই ব্যাপার বলে মনে করছিলেন, সমস্যাটি ছিল তাঁদের নিজের স্তরে । তাঁরা যে-যার নিজের প্রতিস্বগঠনের প্রেক্ষাবিন্দুগুলো খতিয়ে দেখা দরকার মনে করেননি । প্রথমত তাঁরা অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা সমস্যাহীন, সাহিত্য সম্পর্কিত সমস্যাহীন তো বটেই, যখন কিনা জীবনের প্রত্যেকটি এলাকায়, প্রত্যেকেরই, বহু সমস্যা থেকে যায় সমাধানহীন ও সংকটদীর্ণ । দ্বিতীয়ত, তাঁদের সবায়ের শিক্ষাদীক্ষা, যেহেতু ইংরেজরা সবে বিদায় হয়েছিল মাত্র দেড় দশক আগে, ঘটেছিল ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ঘেরাটোপে, যে-গ্রেকোরোমান ও ঔপনিবেশিক সাহিত্যতন্ত্রটি দেশজ অজস্রতার প্রস্তাবনা সামলাতে অক্ষম । সাম্রাজ্যবাদ প্রতিটি উপনিবেশে তার হেলেনিক মননবিশ্বের স্টিমরোলার চালিয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিল বিদ্যায়তনের প্রতিনিধিদের । এনারা ছিলেন এনলাইটেনমেন্টের আদরায় নির্মিত ব্যক্তিএকক । ফলত অনুমিত প্রজ্ঞাপ্রাপ্তিকে ঠাউরেছেন সর্বোচ্চ, ঠিক যেমনটা নেটিভের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবতেন বিলিতি সায়েবরা । নেটিভ যে সত্যিই সাহিত্য-ঐতিহ্যহীন নেটিভ হতে পারে, তার যে থাকতে পারে অসমন্বিত নেটিভত্বের আত্মাভিমান, তার যে এনলাইটেনমেন্ট নিষ্কৃতির ছটফটানি তাকে ম্যাকলে সায়েবের বাঁধন ছিঁড়তে বাধ্য করতে পারে, তা তাঁরা ভেবে উঠতে পারেননি ।                                                               

                                   

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, সুবে বাংলায় এসে, তাদের হেলেনিক মননবিশ্বটির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও প্রসার এমনভাবে করেছিল যে, তদানীন্তন অনির্মিত নেটিভ, এবং ব্রটিশরা জাঁকিয়ে বসার পর নির্মিত প্রতিস্বের বাঙালি ব্যক্তিএকক, এনলাইটেনমেন্টের আদরায় প্রবেশ করে, আবিষ্কার করেছিল যে, নতুন গড়ে ওঠা ভাবকল্প অনুযায়ী, বঙ্গসমাজের মানব-ব্যবস্হাটি প্রকৃতপক্ষে অপলকা, অনিশ্চিত সম্ভাবনাযুক্ত, এবং নির্ভরযোগ্য ভিত্তির অভাবদ্বারা চিহ্ণিত । পশ্চিম ইউরোপের কাছে এই বোধটি, যা আদপে শীতভূখণ্ডের মূল্যবোধপ্রসূত, প্রথম ধাক্কায় অভাবনীয় ঠেকলেও, তাকে সামলাবার জন্য তারা নানা রকম কায়দা উদ্ভাবনের প্রয়োজন বোধ করেছিল, যার মাধ্যমে, সমাজকে আঁটোসাঁটো, বাধ্যতামূলক, ও নির্ভরযোগ্য বনেদের ওপর দাঁড় করানো যায়, এবং সমাজসদস্যদের একরূপতা দেয়া যায় । তাঁদের এই ভাবনাপ্রকল্পে অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাকে চিহ্ণিত করা হয়েছিল শত্রুবাধা হিসাবে, আর শৃঙ্খলাবিন্যাসকে চিহ্ণিত করা হয়েছিল কর্তব্যরূপে । ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা যে-যে উপনিবেশে আধিপত্য বসিয়েছিল, সেসব ভূখণ্ডের নেটিভদের প্রত্যক্ষ করার পর, তাদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা, হীনতা, দীনতা, অনাচার, অনিয়ম, খামখেয়াল, বৈভিন্ন্য, বহুত্ব ইত্যাদি, যে ব্যাপারগুলো খ্রিস্টধর্মী চেতনায় বেমানান আর অসহ্য ঠেকেছিল । তারা সত্যিই বিশ্বাস করত  যে, সবাইকে পিটিয়ে নিজেদের প্রতিবিম্ব বানানো যাবে । যে সমস্ত বিদ্যায়তনিক আলোচকরা হাংরি, অ্যাংরি, বিট কাউন্টার ডিসকোর্সগুলোকে পিটিয়ে নিজেদের মস্তিষ্কে একরূপতা দিচ্ছিলেন, তাঁরা নিজেরা যে ওপরে উল্লিখিত প্রতিবিম্ব, তা খেয়াল করছিলেন না । তাঁদের ভাবনায় কুলোচ্ছিল না, যে, একদল তরতাজা নেটিভ কোনো শর্তে এই ভাবকল্পে প্রতিবিম্বিত হতে রাজি নয়, ভূখণ্ড ও পরিবার পরিসরের স্বতোজাত প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করতে রাজি নয় । বিদ্যায়তনিক আলোচকরা অনুমান করে নিয়েছিলেন, যে, কার্যের কারণ থাকতেই হবে ।


বিদ্যায়তনিক আলোচকরা বিবিধতাকে মনে করেছিলেন বিশৃঙ্খলা, সমরূপ হবার অস্বীকৃতিকে মনে করেছিলেন অন্তর্ঘাত, সন্দেহপ্রবণতাকে মনে করেছিলেন অক্ষমতা, ঔপনিবেশিক চিন্তনতন্ত্রের বিরোধিতাকে মনে করেছিলেন অসামাজিক, ক্ষমতাপ্রতাপের প্রতিরোধকে মনে করেছিলেন সত্যের খেলাপ । তাঁদের ভাবনায় মতবিরোধিতা মানেই যেন অসত্য, প্রতিবাদের যন্ত্রানুষঙ্গ যেন সাহিত্যসম্পর্কহীন । মতবিরোধিতা যেহেতু ক্ষমতার  বিরোধিতা, তাই তাঁরা তার যেকোনো আদল ও আদরাকে হেয় বলে মনে করেছিলেন, কেননা প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে মতবিরোধিতা অনিশ্চয়তার প্রসার ঘটায়, বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত করে; সাহিত্যকৃতি হলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হলে রাষ্ট্রের অবয়বে । ওই প্রতিবিম্বিত ভাবকল্পে, যারা মতবিরোধিতার দ্বারা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে তারা অন্যরকম, তারা প্রান্তিক, তারা সত্যের মালিক নয়, তারা অজ্ঞান । বলাবাহুল্য যে, ক্ষমতা ও সত্যের অমনতর পার্থক্যহীন পরিসরে, যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তাঁদের কব্জায় সত্যের প্রভূত্ব । অজ্ঞানের চিন্তাচেতনাকে মেরামত করে, অতএব, পরিবর্তনের দায় সত্য মালিকের । বিদ্যায়তনিক আলোচকরা যে কাজটি করতে চাইছিলেন, তা হল অবুঝ-অজ্ঞান হাংরি আন্দোলনকে মেরামত করে প্রতিবিম্বের উপযোগী করে তুলতে । আর এই মেরামতির কাজে নেমে তাঁরা ইংল্যাণ্ডের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিট জেনারেশানকেও মেরামত করতে চেয়েছিলেন ।


দুই

গ্রেট ব্রিটেনে, ১৯৫৩ সাল থেকে কয়েকজন লেখক, নাট্যকার ও কবি অ্যাংরি ইয়াং ম্যান রূপে চিহ্ণিত হন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য অ্যালান সিলিটো, জন ব্রেইন, জন অসবর্ন, কলিন উইলসন, জন ওয়েইন, উইলিয়াম কুপার, ফিলিপ লারকিন, বিল নটন, এ. আলভারেজ, আইরিস মারডক, টম ম্যাশলার, লিণ্ডসে অ্যাণ্ডারসন, কেনেথ টাইনান, স্টুয়ার্ট হলরয়েড, ডরিস লেসিং, বিল হপকিন্স এবং কিংসলে অ্যামিস । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান কথাটা চালু হয় যখন জন ওয়েইন ১৯৫৩ সালে তাঁর হারি অন ডাউন রচনাটি বিবিসির একটি অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান । জন ওয়েইনের ব্যবস্হাপনায় পরের বছর পঠিত হয় কিংসলে অ্যামিস লিখিত লাকি জিম এবং ফিলিপ লারকিনের কবিতা, যেগুলো বিবিসিতে আলোচনাকালে এ. আলভারেজ অ্যাংরি ইয়াং ম্যান সম্পর্কে একটি রূপরেখা গড়ার চেষ্টা করেন ।  ১৯৫৬ সালে জন অসবর্নের লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার প্রকাশিত ও মঞ্চে অভিনীত হলে, বিদ্বৎসমাজ অ্যাংরি ইয়াং ম্যান শব্দবন্ধটি সাহিত্যগোষ্ঠীকে চিহ্ণিত করার জন্য প্রয়োগ করা আরম্ভ করেন, যদিও গোষ্ঠী বলতে যা বোঝায়, সেভাবে এনারা সবাই কোনো আড্ডায় বা কর্মকাণ্ডে একত্রিত হতেন না ।

লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার নিয়ে চলচিত্র হল, এবং কাহিনির কেন্দ্রচরিত্র জিমি পোর্টারের ভূমিকায় রিচার্ড বার্টন অভিনয় করলেন, ব্রিটেনের নিম্নবর্গের জনগণ একাত্মবোধ করলেন জিমি পোর্টারের সঙ্গে, এবং অ্যাংরি ইয়াং ম্যান কথাটা সাংবাদিকদের ও জনগণের মধ্যে প্রচলিত হল । তবে, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান বলতে ঠিক কী ধরণের ভাবনাচিন্তা বোঝায়, তার একটা মোটামুটি ধারণা দেবার চেষ্টা ১৯৭৫ সালে টম ম্যাশলার করেছিলেন । তাঁর সম্পাদিত ডিক্লেয়ারেশান্স নামের সংকলনে, কিন্তু তাতে লেখা দিয়েছিলেন কেবল জন অসবর্ন, লিণ্ডসে অ্যাণ্ডারসন, কেনেথ টাইনান, স্টুয়ার্ট হলরয়েড, ডরিস লেসিং, কলিন উইলসন, বিল হপকিন্স এবং জন ওয়েইন । যাঁরা লেখা দেননি তাঁদের কাছে, তাঁদের রচনাবলীকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য অ্যাংরি ইয়াং ম্যান লেবেলটা সংকীর্ণ ঠেকেছিল ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাহিল ব্রিটেনের স্বর্ণডিম্ব প্রসবকারী ভারতীয় উপনিবেশ হাতছাড়া হবার পর ব্রিটিশ যুবসমাজ যে  Zeitgeist ( দিব্যাংশু মিশ্র এর বাংলা করেছেন যুগরুচি, যুগাত্মা, যুগধর্ম, যুগচৈতন্য )  দ্বারা  আক্রান্ত হয়েছিল, ঠিক সেই ব্যাপারটাকেই ধরার চেষ্টা করেছিলেন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান নাট্যকার, কবি ও ঔপন্যাসিকরা, যে যুগচৈতন্য ছিল আচমকা সাম্রাজ্যবাদী দ্যুতি ফুরিয়ে-আসা ব্রিটেনের কন্ঠরোধকারী আত্মপ্রসাদ । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর হয়নি, কেননা তখন তাঁরা কিশোর, অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাঁদের তাঁরা জয়দ্ধনি দিয়েছেন তাঁরা যুদ্ধফেরত খোঁড়া, নুলো, অন্ধ, কানা, বিকলাঙ্গ মহানায়ক । সারা ব্রিটেন তখন ছেয়ে গেছে ঘরকুনো মহানায়কে, যারা যুদ্ধ লড়ে ফিরেছে বা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে লাথি খেয়ে ফিরেছে । প্রাক-বিশ্বযুদ্ধ নিশ্চয়তার পৌঁরুষের জায়গায় তখন দেখা দিয়েছে একটি নপুংসক ব্রিটেন ।  ব্রিটেনের ওই আর্থরাজনৈতিক গরিমার অবসানের কালখণ্ডে যুবসমাজ ও শ্রমিকশ্রেণির মাঝে দেখা দিল ক্রোধ, নৈরাশ্য পরাজয়বোধ ও ক্ষিপ্ততার মিশেল । সমাজের এই রোগটিকে পোষ মানাতে গিয়ে ব্রিটিশ নাগরিক নিজের মানসিক অশান্তি ডেকে আনছিল । ১৯৫৬ সালে সুয়েজখালকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের ল্যাজেগোবরে অবস্হার পর, মুখ চূণ হয়ে গেল একটি সাম্রাজ্যবাদী প্রতাপে আপ্লুত ব্রিটিশ নাগরিকদের । সেসময়ের ব্রিটেনের সংস্কৃতি ছিল পুরুষালি, তাই চোটটা ছিল মোক্ষম । চাকরি-বাকরিতে নারীসমাজকে রাজনৈতিকভাবে হীনম্মন্য করে তোলা হচ্ছিল । ন্যাশানাল সার্ভিস জন্ম দিয়েছিল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের । আমেরিকায় জো ম্যাককার্থি ‘কমিউনিস্ট’ চিহ্ণিত করে যাকে-তাকে হেনস্হা করার যে-আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তার প্রভাব অনুপ্রবেশ করতে পেরেছিল ব্রিটিশ সমাজব্যবস্হাতেও । জোসেফ রেমণ্ড ম্যাককার্থি নামের এই রিপাবলিকান সদস্য ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত সময়ে জাল দলিল-দস্তাবেজের সাহায্যে বহু রাজনীতিক, লেখক, চলচ্চিত্রশিল্পী, সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং সমাজসেবককে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য প্রমাণ করে ভয়ংকর রক্ষণশীল ফ্যাসিবাদী আবহ গড়ে তুলেছিলেন, যাঁর জালজোচ্চুরি শেষাবধি ধরে ফেলেন আইজেনহাওয়ার, কিন্তু ততদিনে জনজীবনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে । স্বভাবতই অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা ছিলেন দক্ষিণপন্হী, এবং অনেকে নিজেদের কেন্দ্রের ডানদিকে বলে অভিহিত করতেন । পরবর্তীকালের আলোচকরা তাঁদের অনেককে, বিশেষ করে অসবর্ন আর কিংসলে অ্যামিসকে, চিহ্ণিত করেছেন প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিকরূপে ।


জন অসবর্ন, জন ব্রেইন, কিংসলে অ্যামিস এবং জন ওয়েইন, প্রথাগত সাহিত্যের কেন্দ্রচরিত্র থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে জন্ম দিলেন এক ভিন্ন নায়কের, যাকে বলা হল দি অ্যান্টি হিরো, যে লোকটা সদাসর্বদা পাঁচিল-ঘেরা সমাজব্যবস্হার সঙ্গে কারণে-অকারণে সংঘর্ষে লিপ্ত, বিশেষ করে চার্চ ও এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে । এসট্যাবলিশমেন্ট  ভাবকল্পটির বহুল প্রয়োগ সর্বপ্রথম অ্যাংরি ইয়ং ম্যান লেখকদের রচনায় দেখা গিয়েছিল । অ্যান্টি হিরো লোকটি নিজেরই জটপাকানো প্রেম, শ্রেণি ও যৌনতার অনুভব-অভিজ্ঞতায় তিতিবিরক্ত । আগের প্রজন্মের সৌম্যকান্তি, শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান, মার্জিত, বাকপটু, শব্দচয়নে অব্যর্থ, প্রেমে পাগল, যন্ত্রণা ভোগরত, অপরিবর্তনীয় রাজনৈতিক আদর্শে সপর্মিত এবং আত্মকেন্দ্রিক নায়কদের সঙ্গে কোনো মিল রইল না অ্যান্টি হিরোর । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান লেখকদের মতনই, যার সঙ্গে প্রথমবার শোয় তাকেই বিয়ে করে না অ্যান্টি হিরো । তারা অনেক শোয়াশুয়ি করে, এবং তখনও তারা যার সঙ্গে শুচ্ছে বা শুয়েছে তার সঙ্গে রাগ-ঝগড়াঝাঁটি করে । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান কেন্দ্রচরিত্রটিও অ্যাংরি ইয়াং ম্যান, দগদগে, অপরিমার্জিত, ঝগড়াটে, তিলে খচ্চর, অনেক সময়ে সমকামী, এমনকি বহুদিন স্নানহীন, যে কিনা সমাজ এবং বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে অক্ষম — গররাজি তো বটেই ।


জন ওয়েইন কৃত কেন্দ্রচরিত্র চার্লস লুমলে, পড়াশোনা শেষ করার পর জানালার শার্সি পোঁছার চাকরি বেছে নেয় । কিংসলে অ্যামিস কৃত কেন্দ্রচরিত্র জিম ডিকসন একজন অধ্যাপক, নিজের ঊর্ধতন অধ্যাপকের সঙ্গে, প্রেমিকার সঙ্গে, সহানুভূতিশীল শুভার্থীদের সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে । জন ব্রেইনের কেন্দ্রচরিত্র জো ল্যাম্পটন প্রেমিকাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজের ওপরতলায় ওঠে, আর মালিকের জামাই এবং উত্তরাধিকারী হয় নানারকম চাল চেলে । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের অন্যতম জন অসবর্ন লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার ছাড়াও লিখেছিলেন দি এনটারটেইনার ( ১৯৫৭ ), ইনঅ্যাডমিসিবল এভিডেন্স ( ১৯৬৪ ), আ প্যাট্রিয়ট ফর মি ( ১৯৬৫ ), লুথার ( ১৯৬১ ), দি হোটেল ইন অ্যামস্টারডম ( ১৯৬৮ ) নাটক, এবং এ বেটার ক্লাস অব পার্সন ( ১৯২৯-৫৬ ) ও অলমোস্ট আ জেন্টলম্যান ( ১৯৫৫-৫৬ ) শিরোনামে দুটি আত্মজীবনী । তাঁর আত্মজীবনী পড়ে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ভাবকল্পটির যে-প্রেক্ষাপ্রতিস্ব গড়ে ওঠে, তা হল কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণির সদস্য না হবার উদবেগ, সমকামী ও উভকামী যৌনতা নিওয়ে গলদঘর্ম যৌবন, এবং ব্রিটিশ সমাজব্যবস্হায় কোনোরকম ক্ষমতা উপভোগ না-করতে পারার গ্লানি । সে-সময়ে ব্রিটিশ সরকার প্রচার করছিল যে, ‘এত ভালো দিনকাল আর কখনও আমাদের ছিল না ।’


লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার এবং তার সমসাময়িক এই ধরণের নাটকগুলোর নামকরণ হয় ‘কিচেন সিং ড্রামা’, কেন না তা প্রথমবার মঞ্চের ওপর সরাসরি উপস্হাপন করেছিল শ্রমিক শ্রেণির নিখুঁত, রাখঢাকহীন, খাঁটি, ঝাঁঝালো, ধাক্কাদেয়া জীবনযাত্রা, যার সঙ্গে দর্শকরা পরিচিত ছিল বলে একাত্ম হতে পারছিল । তার আগে মঞ্চগুলোয় রাজত্ব করত পলায়নী প্রবৃত্তির নাটক, যেগুলোয় দেখা যেত কাচের জানালা খুলে টেনিস খেলার সঙ্গিনী খুঁজছে বোকা-বোকা নায়ক । অসবর্ন এবং অন্যান্য অ্যাংরি ইয়াং ম্যান নাট্যকাররা যে সেসময়ে সামনের সারির দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন, নাটকগুলো বেশ সিরিয়াস হওয়া সত্ত্বেও, তা এইজন্য যে, নাটকগুলো ছিল এক ধরণের প্রচ্ছন্ন ইশারা যে, মানুষের চরিত্রে আছে বিপরীত শক্তির যুগপৎ বিদ্যমানতা । তাঁদের নাটক ও উপন্যাসের দর্শক-পাঠক গ্রাহীতার আরেকটি কারণ হল ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত ব্রিটেনে লেবার পার্টির শাসন, যে দলটি সম্পদ সৃষ্টির চেয়ে সম্পদ বন্টনে অধিকতর গুরুত্ব দিলেও, নিম্নবর্গের কাছে অতিরিক্ত সম্পদ পৌঁছোচ্ছিল না । তারপর ১৯৫১ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত কনজারভেটিভ দল এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত লেবার দল একই নীতি বজায় রেখেছিল, যাকে ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচার এসে জলাঞ্জলি দেন । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের চোখে প্রাক-থ্যাচারের সরকারই মূলত এসটভাবলিশমেন্ট হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছিল । ১৯৭৯ সালে কনজারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় এসে যখন নীতির পরিবর্তন ঘটাল, এবং সরকারে থেকে গেল টানা আঠারো বছর, বৌদ্ধিক হাতিয়ার হিসাবে ক্রমে-ক্রমে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছিল অ্যাংরি ইয়াং ম্যান পাঠকৃতিগুলো ।


অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা তাঁদের নাটক-উপন্যাসের কেন্দ্রচরিত্রে, ফিলিপ লারকিন তাঁর কবিতায়, নিজেদের পার্সোনা চাপিয়ে দিতে কসুর করেননি, এবং সেগুলোর অনেকটাই কল্পিত । অধিকাংশ ক্ষেত্রে, জন অসবর্নের ক্ষেত্রে তো বটেই , পার্সোনাটি মাইসোজিনিস্ট বা স্ত্রীদ্বেষী । সবাই কেমন ভাবে বেঁচে আছে, লেখক হিসাবে তা চিন্তা করার পরিবর্তে তাঁরা জানিয়ে গেছেন ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি’ । তাঁদের পাঠকৃতিতে ফলত খোঁচার মতন থেকে গেছে বদমেজাজ, রুক্ষতা, ঈর্ষা, সঞ্চিত বিদ্বেষ, হিংসুটে ঘৃণা, ইত্যাদি যা ব্যক্তিজীবনের প্রাণচাঞ্চল্যকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে ।


অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের মধ্যে একমাত্র কলিন ইলসন চেষ্টা করেছিলেন তাঁর প্রজন্মের প্রতিস্ব নির্মাণের উপাদান ও লক্ষণগুলোর কার্যকারণের সামাজিক-দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে বের করার । যদিও তিনি কয়েকটি উপন্যাস লিখেছিলেন, তিনি আজও প্রাসঙ্গিক ও পঠিত তাঁর ‘দি আউটসাইডার’ প্রবন্ধগ্রন্হের জন্য । ব্রিটিস সংস্কৃতি অবিনির্মাণ করে আরও অনেকগুলো গ্রন্হ তিনি পরে লিখেছিলেন । প্রথম দিকের অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের মতন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সুযোগ কলিন উইলসনের হয়নি । তিনি প্রকৃতই নিম্নবর্গ শ্রমিক পরিবারের সন্তান, এবং ‘দি আউটসাইডার’ প্রকাশিত হবার আগে বেশ কঠিন জীবন কাটাতে হয়েছে । এই জীবনসংঘর্ষ নিয়ে তিনি ‘অ্যাড্রিফ্ট ইন সোহো’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন । তবে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের মধ্যে এই ধরণের জীবনযাত্রা নিয়ে লেখা বহুচর্চিত উপন্যাসটি হল অ্যালান সিলিওট রচিত ‘দি লোনলিনেস অব দি লং ডিসটভান্স রানার’ উপন্যাস । মদ খাবার ব্রিটিশ ঐতিহ্যের বাইরে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা নেশাভাঙ করতেন না । ব্রিটিশ পোশাকের চিরাচরিত অনুশাসন মেনে চলতেন তাঁরা ।


কলিন উইলসন রচিত ‘দি আউটসাইডার’ গ্রন্হটি প্রকাশিত হবার পর অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পাঠকৃতি, যেগুলো প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মোহমুক্তির ব্রিটিশ ফসল, দার্শনিক ব্যাখ্যা পেল । ব্যাখ্যার অতীত এক বিদকুটে জগতে ব্যক্তিমানুষ নিজেকে তাতে প্রবিষ্ট হিসাবে আবিষ্কার করে, যখন কিনা তার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ইচ্ছেমতন যাচাই-বাছাই করে নিজের করণীয় কাজগুলো নির্ণয় করে । এই বক্তব্য থেকে অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পাঠকৃতির সাধারণীকরণ করলে যা দাঁড়ায়, তা হল এউ উপাদানগুলোর গুরুত্ব : ব্রিটীস ব্যক্তিমানুষ, যাচাই-বাছাই করার অভিজ্ঞতা, বিশ্বজগত সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত বোঝাপড়ার অবর্তমানতা, এবং ব্যক্তিজীবনের অসামঞ্জস্য -অযৌক্তিকতা-হাস্যকরতা-অসম্ভাব্যতাকে কেন্দ্র করে এক ধরণের বোধ, যাকে বলা যায় আতঙ্ক । আতঙ্কের এই বোধকে সামাল দেবার জন্য প্রয়োজন হয় ক্রোধ, বদমেজাজ, রুক্ষতা, ক্ষোভ, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, কুচুটেপনা, হিংসুটেভাব, ঘৃণা ইত্যাদি ।


বহু প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবুকের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, গ্রেট ব্রিটেনে যেমন আলফ্রেড টেনিসন, ফ্রান্সে রেজি দেব্রে, পশ্চিমবঙ্গে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, কয়েকজন অ্যাংরি ইয়াং ম্যান, মার্গারেট থ্যাচারের কৃপায়, প্রতিষ্ঠানের প্রবক্তায় রূপান্তরিত হন । কিংসলে অ্যামিস পান নাইটহুড, রানি এলিজাবেথের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলে, রানি তাঁর রাজ-তলোয়ার অ্যামিসের মাথায় ছুঁইয়ে তাঁকে প্রতিষ্ঠানের সেবক ঘোষণা করেন, ঠিন যেমন একশো ত্রিশ বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল টেনিসনের ক্ষেত্রে । জন ওয়েইন হয়েছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিতার অধ্যাপক । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের পর সংঘবদ্ধভাবে আর কোনো সাহিত্যিক আন্দোলন সম্ভব হয়নি ইউনাইটেড কিংডামে ।


তিন

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ধনাতক, বিত্তশালী পরিবারের ছেলে, গদ্যলেখক উইলিয়াম বারোজ যখন নিউ ইয়র্কে ছিলেন তখন তাঁর মেস-বাড়ির বন্ধু, হার্বার্ট হাংকে নামে এক ছিঁচকে চোর ও ঠগের মুখে ১৯৪৪ সালে তিনি প্রথম ‘বিট’ শব্দটি শোনেন । হাংকে বারোজকে হেরোইনের নেশা করতে শিখিয়েছিলেন । বারোজ হাংকেকে শিখিয়েছিলেন লিখতে । আরেকজন উঠতি গদ্যলেখক, কোলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যা।য় থেকে বহিষ্কৃত ছাত্র জ্যাক কেরুয়াকের যাতায়াত ছিল উইলিয়াম বারোজের কাছে । হাংকের কথাবার্তায় বারংবার ‘বিট’ শব্দটির উল্লেখ শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যে শব্দটির অর্থ হল মনমরা অবজ্ঞা । তাঁর মনে হয়েছিল ‘বিট’  অভিধাটিতে রয়েছে এমনই এক গভীর পরোক্ষ বৈশিষ্ট্য যা রহস্যময় এবং আধ্যাত্মিক, অনেকটা হারমান মেলভিলের গল্পের আদি মার্কিন ননকনফরমিস্ট বার্টলবি নামের মুসাবিদকারীর চরিত্রে যে বৈশিষ্ট্য ছিল । কেরুয়াকের বন্ধু, কোলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, কবি যশোপ্রার্থী, অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন বিট শব্দটি হাংকের কথাবার্তায় এবং টাইমস স্কোয়ারের দুষ্কৃতিদের কথোপকথনে শোনেন তখন তিনি বুঝতে পারেন যে ওই অঞ্চলে বিট শব্দটির অর্থ হল পরিশ্রান্ত, ঘুমহীন, সমাজের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, ইন্দ্রিয়তাড়িত, রাস্তাছাপ, সন্মানের অযোগ্য, খেইহীন এবং আত্মনির্ভর মানুষের অবস্হা ।


গিন্সবার্গের সঙ্গে ওই আড্ডায় যোগ দিয়েছিলেন আরেকজন কবি যশোপ্রার্থী, কোলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লুসিয়েন কার, যিনি গিন্সবার্গকে উইলিয়াম ব্লেক ও জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর কবিতা ও জীবনী পড়তে দেন, এবং পরিচয় করান বেনজেড্রিন ও মারিহুয়ানা নেশার সঙ্গে, যাতে ওই কবিদের মতন তাঁরাও কবিতা লেখার এক নবীনতম দিব্যদৃষ্টি পান । কেরুয়াকের সঙ্গে পরিচয় ছিল আরেকজন উঠতি লেখকের, তাঁর নাম জন ক্লেলান হোমস, যিনি সামাজিক সাংস্কৃতিক বাঁকবদলগুলো পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসতেন । তাঁদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যাকে বলা হত লস্ট জেনারেশান, তার থেকে তাঁদের প্রজন্মের পার্থক্য কী, হোমসের এই প্রশ্নের জবাবে কেরুয়াক বলেছিলেন যে, তাঁদের নিজের প্রজন্মে রয়েছে অস্হির অনুসন্ধানস্পৃহা, বাস্তবের প্রতি ভিন্ন মনোভাব, উচ্ছ্বসিত চাঞ্চল্য, যাবতীয় ফর্ম সম্পর্কে ক্লান্তি, সমাজের নিয়ম-নিষেধ সম্পর্কে বিরক্তি, যা এক ধরণের অলক্ষিত কারবার । কেরুয়াক বলেছিলেন যে তাঁদের প্রজন্মে লোকদেখানো ব্যাপার নেই, তাঁরা ‘বিট জেনারেশান’ ।


মার্কিন লস্ট জেনারেশান বলতে বোঝাত সেই সব লেখকদের যাঁরা স্বদেশের প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রক্ষণশীলতা, ধর্মের গোঁড়অমি, নীতিবাগীশদের বক্তৃতা, মদ্যনিষেধ, সংস্কৃতি সম্পর্কে উদাসীনতা এবং ‘বোকা রাষ্ট্রপতিদের’ এড়াবার জন্যে প্যারি শহরে গিয়ে বসবাস করতেন, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, কে বোয়েল, রবার্ট ম্যাকঅ্যালমন, হেনরি মিলার প্রমুখ । এফ স্কট ফিটজেরাল্ড বলেছিলেন যে, তাঁদের পরের প্রজন্ম গড়ে উঠেছে আগের প্রজন্মের উন্মাদ ও উন্মার্গগামীদের কারণে । জন ক্লেলন হোমস বিট জেনারেশান কথাটা প্রয়োগ করা আরম্ভ করেন উপরে উল্লিখিত উইলিয়াম বারোজের আড্ডার লেখকদের ক্ষেত্রে, যাঁরা হঠাৎ শীতযুদ্ধের আবহে আটকে পড়ার ফলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে চাইছে । এই প্রজন্ম, ব্যাখ্যা করলেন হোমস, চিরাচরিত মধ্যবিত্ত ভোগবাদের সঙ্গে আপোস করতে চায় না, বশ্যতা স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু প্রথাগত শর্তাবলীর প্রতি অক্ষমতা সত্ত্বেও মূল্যবোধে বিশ্বাস করতে চায় । বিট জেনারেশানের খ্যাতির দরুণ পরে যখন আমেরিকা জুড়ে বহু সাহিত্য যশোপ্রার্থী নিজেদের বিট ঘোষণা করতে লাগলেন, তখন ১৯৫৮ সালে এসকোয়ার পত্রিকায় ( দি ফিলজফি অব দি বিট জেনারেশান ) এবং ১৯৫৯ সালে প্লেবয় পত্রিকায় ( দি অরিজিন্স অব দি বিট জেনারেশান ) কেরুয়াক বলতে বাধ্য হন যে বিট জেনারেশান বলতে পাঁচ-ছয় জনের একটি নিউক্লিয়াস বোঝায়, এবং চারিদিকে যে ‘জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্ট’ দেখা যাচ্ছে, তাদের বোঝায় না ।

বারোজ-কেরুয়াক-গিন্সবার্গকে নকল করে আমেরিকায় যেসব উঠতি লেখকরা উদয় হচ্ছিল, স্যান ফ্রানসিসকো ক্রনিকল ১৯৫৮ সালে রাশিয়ার ছাড়া স্পুটনিকের আদলে তাদের নামকরণ করল  বিটনিক । লুক ম্যাগাজিন বিট জেনারেশানের সদস্যদের জন্যে একটা পার্টি দিলে, তাতে হাজির হয়েছিল দাড়িগোঁফঅলা বিদকুটে পোশাকের আড়াইশো বিটনিক যুবক-যুবতী । এসব দেখেশুনে হোমস লিখলেন যে বিটনিকরা আর গণমাধ্যম মিলে বিট জেনারেশানের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনকে খেলো, ধোঁয়াটে, হাস্যকর আর বুদ্ধিহীন করে দিয়েছে ।  বিটনিকদের আবির্ভাবের পর গিন্সবার্গ ছাড়া বাদবাকি সবাই বিট অভিধায় চিহ্ণিত হতে অস্বীকার করতেন । ওভাবে চিহ্ণিত হবার ভয়ে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে বিভিন্ন শহরে চলে যান তাঁরা । বিট জেনারেশান আদপে সাহিত্যিকদের একটা ছোটো গোষ্ঠী হলেও, গণমাধ্যমের প্রচারে বোহেমিয়ান সাহিত্যিকরা, বা উল্টোপাল্টা হাবভাব করতে এমন শিল্পী ও কবি, সবাই বিট তকমা পেতে শুরু করেছিল ।


জাপানে আণবিক বোমা ফেলার পর, এবং নানারকমভাবে কমিউনিস্ট আতঙ্ক সৃষ্টি করে বামপন্হী মতামতকে দ্বিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কুড়ি বছর যেভাবে আমেরিকায় লেখক-কবি-শিল্পীদের কোনঠাসা করা হয়েছিল, যে, নিজেদের স্বাধীন লেখালিখির জন্যে বিদেশে পালিয়ে না গিয়ে খোদ আমেরিকায় বসে যুব সম্পদায়েরব মননবৃত্তিতে যে বিদার ঘটে, তারই ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও নান্দনিক ফসল হল বিট প্রতিসন্দর্ভ, কাউন্টার কালচার । অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেছেন যে, সে সময়ে যুবসম্প্রদায় বাধ্য হয়ে মনে মনে গোপন নায়কদের রোল মডেল করে নেয়া আরম্ভ করেছিল । যেমন পপ সঙ্গীতকার চার্লি পার্কার ও ডিজি গিলেসপি, ফরাসি ভিশনারি কবি আর্তুর র‌্যাঁবো, ওয়েলসের মদ্যপ কবি ও অভিকারিক ডিলান টমাস, ফরাসি ইনসেনডিয়ারি কবি-নাট্যকার আতোয়াঁ আর্তো, আত্মনির্বাসিত কবি-ঔপন্যাসিক ডি, এচ লরেন্স, ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যানার্কিস্ট কবি কেনেথ রেক্সরথ প্রমুখ । লস্ট জেনারেশানের কবি-লেখকরা যেমন বাড়ি ছেড়ে প্যারি মহানগরীতে পালিয়েছিলেন, তেমনি বিট জেনারেশানের নিউক্লিয়াস সাহিত্যিকরা, অর্থাৎ উইলিয়াম বারোজ, জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গ্যারি স্নাইডার, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, গ্রেগরি কোরসো, জন ক্লেলন হোমস, মাইকেল ম্যাকক্লুর, ফিলিপ হোয়ালেন, ডায়না ডিপ্রাইমা, লেরয় জোনস ( আমিরি বারাকা ) প্রমুখ, ছোটো ছোটো শহর ও গ্রাম থেকে পালিয়ে জড়ো হয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক ও সানফ্রানসিসকো মহানগরীতে।


বিট অভিধাটি আশ্রয় করে প্রাগুক্ত সাহিত্যিকদের পক্ষে, প্রথম দিকে, নিজেদের সংজ্ঞায়িত করতে সুবিধা হয়েছিল । পাঠকদের কাছেও তাঁদের পাঠকৃতির বৈশিষ্ট্য পৌঁছে দেবার জন্যে কাজে দিয়েছিল বিট অভিধাটি । হোমস বলেছেন যে, পাঠকের কাছে বিট সাহিত্য পৌঁছে গিয়েছিল সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাতের প্রগাঢ় আকর্ষণ নিয়ে, পৌঁছে দিয়েছিল একরকম বিকল্প ইমেজ, পৌঁছে দিয়েছিল নবীন মার্কিনী অপ্রতিরোধ্য যুবাচরিত্রর ছবি, যার সঙ্গে পূর্বসূরীদের মিল বলতে আদি আমেরিকান বাধাবন্ধনহীনতা । লস্ট জেনারেশানের সাহিত্যিকরা আমেরিকানদের চোখের আড়ালে প্যারি মহানগরীতে বসে বোহেমিয়ান জীবন কাটাবার ফলে মার্কিন সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারেননি । বিট জেনারেশানের বিপুল প্রভাব দেখা দিল আমেরিকার সংস্কৃতিতে । প্রথমে আবির্ভুত হল বিটনিকরা, যাদের প্রভাবে ভিয়েৎনাম যুদ্ধের সময়ে দেখা দিল হিপিরা, যাদের প্রভাবে দেখা দিল পাংকরা । নেশা করায়, যৌনজীবনে, পোশাকে, জীবনযাপনে, লেখায়, আঁকায়, কবিতা পাঠে, রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের বিরোধীতায়, গ্রন্হ প্রকাশে, ধর্মাচরণে, খাওয়াদাওয়ায় প্রতিফলিত হল বিট জেনারেশানের বাধাবন্ধনহীনতা । বামপন্হী মতামত প্রকাশের জন্যে, মার্কিন সংস্কৃতির একেবারে মাঝখানে, কায়দা করে তাঁরা গড়ে ফেললেন এমনই একটি পরিসর, যে, তাঁদের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অবদানকে গ্রহণ করতে বাধ্য হল আমেরিকার মূলস্রোত ।


পর পর কয়েকটি গ্রন্হের প্রকাশ মার্কিন গণমাধ্যমকে আকর্ষণ করেছিল বিট সাহিত্যের প্রতি । সেগুলো হল অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ( ১৯৫৬ ), জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দি রোড’ ( ১৯৫৭ ), গ্রেগরি কোরসোর ‘বম্ব’, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির ‘কোনি আইল্যাণ্ড অব দি মাইন্ড’ ( ১৯৫৮ ) এবং উলিয়াম বারোজের ‘নেকেড লাঞ্চ’ ( ১৯৫৯ ) । এই সময় পরিসরে, আমেরিকায় আগে যা হয়নি, ঘটল লিটল ম্যাগাজিন বিস্ফোরণ । বিটদের রচনা, অথবা বিটদের মতন সাহিত্যকৃতিতে, ছেয়ে গেল আমেরিকা জুড়ে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনগুলোয় । হাউল, অন দি রোড এবং নেকেড লাঞ্চ কী ভাবে রচিত হয়েছে, সে-সম্পর্কিত মিথ, যা গড়ে তুলতে বিটরা নিজেরাই সচেষ্ট ছিলেন, তা গণমাধ্যমের সাহায্যে  ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় । হাউল দীর্ঘ কবিতাটি রচিত হয়েছিল নেশার ঘোরে । অন দি রোড উপন্যাস একটানা টাইপ করা হয়েছিল কাগজের পাকানো বাণ্ডিলে । নেকেড লাঞ্চ লেখা হয়েছিল লিখিত বাক্যকে কাঁচি দিয়ে কেটে আর জুড়ে । “আগেকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে তাঁদের কাজ কী ভাবে লেখা হয়েছে”, গ্রেগরি কোরসো বললেন, “কেবল তাতেই সীমিত নয় ; তাতে আনা হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তির মিশ্রণ, বিলম্বিত ও দ্রুত বাক্যের মিশেল, কাটাছাঁটা পরাবাস্তব রূপকল্প, নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ না-দেয়া বাক্য, উপর্যুপরি ক্রিয়াপদ প্রয়োগ, শব্দবন্ধের ঝাঁপাই, ঝুলে যাওয়া ছন্দ, ঠাণ্ডামেজাজ-গরমমেজাজের চালাচালি, আর সর্বোপরি, রচনাকারের আত্মা ।”


উপরোক্ত তিনটি বইতে লেখকরা অন্যান্য বিটদের প্রসঙ্গ এনেছেন, এবং সেই সূত্রে খোলাখুলি বয়ান করেছেন পুরুষ সমকাম, যে-ব্যাপারটি তার আগে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বা ইশারায় বলা হতো । বিট লেখিকারা, ডায়না ডিপ্রাইমা, ক্যারল বার্জ ও মার্গারেট র‌্যানডাল ছাড়া, লেখকদের প্রচারের আলোয় প্রেমিকা বা স্ত্রী হিসেবে চাপা পড়ে গেছেন অনেকে, যেমন ক্যারলিন ক্যাসডি, বনি ব্রেমজার, হেটি জোন্স প্রমুখ । লেসবিয়ান উপস্হিতি পাওয়া যায় বিটনিক ও হিপিদের প্রজন্ম থেকে । চূড়ান্ত ভোগবাদী সমাজে, বিট ভাষ্যকাররা পরবর্তীকালে ব্যাখ্যা করেছেন, প্রথানুগত পারিবারিক জীবনকে এড়াবার জন্যে নেশা এবং পুরুষে-পুরুষে সম্পর্কে জরুরি ছিল । রসায়নবিদ টিমথি লিয়ারির দিশানির্দেশে সমস্তরকম নেশা তাঁরা করেছেন, এমনকী এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার মাদক নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যখনই তাঁরা সেসব দেশে গেছেন । বিটদের সাহিত্য ও জীবনযাপনকে সেকারণে বলা হয়েছিল মার্কিন ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রথম সর্বব্যাপী যুদ্ধ । তারপরই শুরু হয় নাগরিক অধিকার আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, যৌন স্বাধীনতার আন্দোলন, বিদ্যায়তনিক আধিপত্য-বিরোধী আন্দোলন, রক মিউজিকের আন্দোলন, যা অকল্পনীয় ছিল বিট জেনারেশানের আগে । পুলিটজার পুরস্কার পাবার পর গ্যারি স্নাইডার বলেছিলেন, ” বিট হল মনের এক বিশেষ অবস্হা, আর সেই মানসিক অবস্হায় আমি কিছুকাল ছিলুম”। আর কোনো বিট কোনো পুরস্কার পাননি, কেননা সুযোগ পেলেই তাঁরা কলমে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়েছেন সমাজ অধিপতিদের । তবে মৃত্যুর পর তাঁদের পাণ্ডুলিপি-নথিপত্র কোটি-কোটি ডলারে কিনেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় । গিন্সবার্গ জীবিতকালেই এক মিলিয়ন ডলারে তাঁর সংগ্রহের চিঠিপত্র ও বই ইত্যাদি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে বিক্রি করেছিলেন ।


বিট জেনারেশান আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর আমেরিকা জুড়ে যখন বিটনিক আর হিপিদের আবির্ভাব হল, তখন ১৯৬০ সালে, বিটদের নিয়ে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল : সেমোর ক্রিম সম্পাদিত দ্য বিটস, এলিয়াস উইলেঞ্জ সম্পাদিত দি বিট সিন, এবং স্ট্যানলি ফিশার সম্পাদিত বিট ইস্ট কোস্ট : অ্যান অ্যানথলজি অব রিবেলিয়ান ।  বিট লেখকদের পরিত্যক্ত গ্রিনিচ ভিলেজের পথা পথে ঘুরে স্ট্যানলি ফিশার বিটনিকদের জিগ্যেস করেছিলেন যে বিট বলতে তারা কী বোঝে । তিনি দেখলেন যে প্রত্যেকের সংজ্ঞা আলাদা । মোটামুটি যে মিল তিনি পেলেন তা হল ১) জেদি বেপরোয়াভাব যা তাবৎ রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ফর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করে ; ২ ) সহজ প্রবৃত্তির দ্বারা প্রাপ্ত ভাবকল্প যা ব্যক্তিগত মনোভঙ্গী গড়ে দ্যায় অথচ যাকে ব্যক্ত করার জন্য কোনোও শব্দ নেই, এবং ৩ ) অত্যন্ত ক্লান্ত মানুষ, ভালোভাবে বেঁচে থাকার আগেই যে লোকটা ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত । অর্থাৎ পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশানে বিগত পাঁচ-সাত বছর বিট বলতে আত্মার পরিশীলন বিষয়ক যে বক্তৃতাগুলো কেরুয়াক দিয়েছিলেন, তা হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল ।


প্রথম দিকে সাহিত্য-শাসকরা বিট জেনারেশানকে পাত্তা দেননি । কিন্তু গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ছাপার জন্যে প্রকাশক লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির বিরুদ্ধে শুল্ক দপতর মামলা করায় যে হইচই হল, তার ফলে বিট জেনারেশানের লেখক-কবিদের বইপত্র প্রচুর বিক্রি আরম্ভ হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও, তখন তাঁদের টনক নড়ল । লরেন্স ফেরলিংঘেট্টির বইয়ের দোকানকে কেন্দ্র করে একদল সুশিক্ষিত তরুণ আলোচক একত্রিত হয়েছিলেন, যাঁরা বিট সাহিত্যের সময়ানুগ আলোচনা করতে লাগলেন, যুবা পাঠকদের কাছে স্পষ্ট করতে লাগলেন বিট জেনারেশান কেন ও কীভাবে আক্রমণ করছে ভোগবাদী সমাজকে, পুঁজিবাদকে, মিলিটারি-ঔদ্যৌগিক স্বার্থকে, রেসিজমকে, পরিবেশ দূষণকারীদের ; কেন ও কী ভাবে বিট সাহিত্য সামাজিক, যৌন, রাজনৈতিক ও ধার্মিক মূল্যবোধকে ক্ষতিকর বলে দোষারোপ করছে ।

উইলিয়াম বারোজ বলেছেন যে, বিট জেনারেশান যে কমিউনিস্ট পার্টির চেয়েও পরাক্রমী, আর অপরিবর্তনীয় ঝড় তুলে ফেলেছে, তা বিটরা নিজেরা টের পাবার আগেই বুঝে ফেলেছিল মার্কিন রক্ষণশীলরা । বিটরা, তিনি বললেন, আমেরিকার বুকে মোক্ষম সময়ে হাজির হয়েছে, যখন দেশে-দেশে বুদ্ধিজীবিরা আমেরিকার বিট কন্ঠস্বর শোনার জন্যে অপেক্ষা করছিল , কেননা শিল্পী-সাহিত্যিকরাই পরিবর্তনের স্হপতি, তাঁরাই প্রভাবিত করেন জীবনশৈলী, এবং উপলব্ধির ধরণ-ধারণ, চৌহদ্দি ও অভিমুখ । ধর্ম নিয়েও ভাবনাচিন্তা করেছেন বিটরা । ইহুদি অ্যালেন গিন্সবার্গ গ্রহণ করেছিলেন তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম । কৃষ্ণাঙ্গ লেরয় জোনস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আমিরি বারাকা হন । খ্রিস্টান গ্যারি স্নাইডার গ্রহণ করেন জেন বৌদ্ধধর্ম ।


চার


ব্রিটেনের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান এবং আমেরিকার বিট জেনারেশানের যে কোনো মিল নেই তা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে, এমনকী শ্বেতাঙ্গ হহোয়া সত্ত্বেও তাঁদের ধর্মাচরণেও মিল নেই । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের ওই শ্বেতাঙ্গ হবার মিলটুকুও নেই । লেখালিখি শুরু করার বেশ কিছু পরে লেখক-বিশেষের ক্ষেত্রে অ্যাংরি এবং বিট অভিধা প্রয়োগ হয়েছিল, তাদের বলা হয়েছিল আন্দোলন । পক্ষান্তরে, ১৯৬১ সালে প্রকাশিত প্রথম হাংরি বুলেটিনটি ছিল কবিতার ম্যানিফেস্টো, অর্থাৎ আবির্ভাবমাত্রেই, হাংরি নিজেকে আন্দোলন হিসেবে ঘোষণা করেছিল । পাটনায় বাংলা ছাপাবার সুবিধা না থাকায়, ম্যানিফেস্টোটি মলয় রায়চৌধুরী ইংরেজিতে লিখেছিলেন, এবং লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, অ্যাংরি ও বিটদের থেকে তা ছিল একেবারে আলাদা প্রতিসন্দর্ভ ।


এই ইশতাহারটি আরেকবার ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশের সময়ে শেষ প্যারাটি পরিবর্তন করে একটি অতিরিক্ত প্যারা সংযোজন করেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । ম্যানিফেস্টোটি এরকম : Poetry around us, these days, has been cryptic, short hand, cautiously glamourous, flattered by own sensitivity like a public school prodigy. Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic or the bier of unsexed rhetoric.

Poetry is not the caging of belches within form. It should convey the brutal sound of breaking values and starking tremors of the rebellious soul of the artist himself, with words stripped of their usual meaning, and used contrapuntally. It must invent a new language which would incorporate everything at once, speak to all the senses in one. Poetry should be able to follow music in the it possesses of evoking a state of mind, and to present images not as wrappers but as ravishograms.


এই ইশতাহারটি ১৯৬৩ সালে আরেকবার মুদ্রিত হয়েছিল এবং সেটিতে হাংরি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সবায়ের নাম ছাপা হবেছিল । এর পর হাংরি আন্দোলনকারীরা ধর্ম, ছোটোগল্প, সমালোচনা-পদ্ধতি, রাজনীতি, সমাজ, ইতিহাস, উদ্দেশ্য, অশ্লীলতা, স্বাধীনতা, আন্দোলন, পেইনটিং ইত্যাদি বিষয়ে ম্যানিফেস্টো পপকাশ করেন, যা অ্যাংরি ও বিটসহ পৃথিবীর কোনো আন্দোলনে কখনও করা হয়নি । ১৯৬১ সালে আন্দোলন আরম্ভ করার সময়ে হাংরি নিউক্লিয়াসটিতে ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরী । তাঁরা ইংরাজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম  বাক্যটি থেকে হাংরি শব্দটি এই জন্যে চয়ন করেছিলেন যে, উত্তরঔপনিবেশিক  স্বাধীন ও সমৃদ্ধ ভারতের স্বপ্ন ততদিনে টকে পচতে শুরু করেছিল । জার্মান দার্শনিক ওসওয়াল্ড স্পেংলার ( ১৯৮০-১৯৩৬) এর  দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট  গ্রন্হ থেকে নিউক্লিয়াস সদস্যদের কাছে মলয় রায়চৌধুরী ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, স্পেংলারের মতে, ইতিহাস কেবল একটিমাত্র রেখা বরাবর এগোয় না, তা বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; স্পেংলারের মতে হেগেলের এই তর্কটি ভুল যে, ইতিহাস যুক্তিসংগতভাবে এগোয় ; তাঁর মতে ইতিহাস হল জৈবপ্রক্রিয়া, কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগে থাকতে বলা যায় না ; একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে সংস্কৃতিটি নির্বিচারে যা পায় তা-ই খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । মলয় রায়চৌধুরী বলেছিলেন যে, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয় । লক্ষনীয় যে অ্যাংরি এবং বিট অভিধা দুটির মতন হাংরি শব্দটি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া নয় বা আচমকা পাওয়া নয় । হাংরি শব্দটি তার গভীর দার্শনিক দ্যোতনার জন্যে আরম্ভসূত্রেই গৃহীত হয়েছিল । এও স্পষ্ট হবে গিয়ে থাকবে যে অ্যাংরি, বিট ও হাংরি অভিধা তিনটির আন্দোলনীয় মর্মার্থে সাদৃশ্য ছিল না ।


প্রশ্ন উঠতে পারে যে অ্যাংরি, বিট ও হাংরি, তিনটি আন্দোলনেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিসর দেয়া হয়েছে । তা হয়েছে বটে, কিন্তু এরা যাদের আক্রমণ করেছে তারা চরিত্রগতভাবে একই ক্ষমতাকেন্দ্র নয় । প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হাংরি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমুখ ছিল নিঃসন্দেহে, যে কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আন্দোলন ত্যাগ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের অঙ্গাঙ্গী করে নিয়েছিলেন পরবর্তিকালে । বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর, প্রফুল্ল সেন মুখছমন্ত্রীত্বে আসীন হলে, সুবিমল বসাক যখন হাংরি আন্দোলনে যোগ দিলেন, তখন সুবিমল-দেবী-মলয়ের ( হাংরি ট্রৌইকা নামে খ্যাত ) দ্বারা রাষ্ট্র-পুঁজি-বিশ্ববিদ্যালয়-সংবাদ মাধ্যম-সাহিত্যসংস্কৃতি শাসক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা পদ্ধতিতে আক্রান্ত হল, যার কয়েকটি পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলেছিলেন সাহিত্য-সম্পর্কহীন কার্যকলাপ, অসামাজিক ও অশালীন উদ্ভট ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি । তা সম্ভবত এইজন্য যে, ঔপনিবেশিক মননবিশ্বের আদরা হুবহু বজায় ছিল প্রতিষ্ঠানের মহলগুলোয়, এবং তখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ঠিক মতন পরিচিত হয়নি ঘেরাও, ধর্না, অবরোধ, রেল রোকো, গেটসভা, মোড়মিটিং ইত্যাদি ছোটো-ছোটো কাউন্টার ডিসকোর্সের সঙ্গে । তারপর নকশাল আন্দোলন আরম্ভ হতে প্রতিষ্ঠানের বোলতি বন্ধ হয়ে গেল ।


অ্যাংরি ও বিটরা হাংরি আন্দোলনকারীদের মতন সরাসরি প্রতিষ্ঠানবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন না । হাংরি আন্দোলনকারীরা কাজে ও লেখায় অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের রাগ, বদমেজাজ, রুক্ষতা, ক্ষোভ, বিদ্বষ ইত্যাদি ছিল না । হাংরি আন্দোলন ১৯৬৫ সালে ফুরিয়ে যাবার পর সুভাষ ঘোষ-এর যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট, শীর্ষ অভিযান, সাবিত্রীবালা, ৫ আইন, মানুষ নামের লীলা বইগুলোতে যা আছে তা হল শিকড়হীনতার উদবেগ, ফালতু বোধ করার অসন্মান, একঘরে হবার আতঙ্ক । দেবী রায়-এর মানুষ মানুষ, দেবী রায়ের কবিতা, ভ্রূকুটির বিরুদ্ধে একা, উন্মাদ শহর, এই সেই তোমার দেশ,  পুতুল নাচের গান, সর্বহারা তবু অহঙ্কার  বইগুলোয় আছে নিম্নবর্গে অবস্হানজনিত উপেক্ষার প্রতিরোধ, আছে সমাজ-প্রত্যাখ্যাত হবার পীড়া, অস্বীকৃতির ছটফটানি । বস্তুত কী ভয়ংকর বর্ণজাঁতিকলে পিষে গেলে একজন লোক এফিডেভিট করে তার নাম-পদবি পালটাতে বাধ্য হয় তা অ্যাংরি ও বিট ভাবনাদর্শন প্রয়োগ করে বোঝা সম্ভব নয় । দেবী রায়-এর প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া । সুবিমল বসাকের কবিতা-পুস্তিকা হাবিজাবি আর বকবকানি মূলত প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্লেষ, এবং যে-রাজনীতিকরা স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেরাই শেষমেশ অধঃপতনের গাড্ডায় পড়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে তীব্র ব্যঙ্গে পরিপূর্ণ । এই শ্লেষ ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ত্রিদিব মিত্রের হত্যাকাণ্ড এবং ঘুলঘুলি কবিতা-পুস্তিকাতেও ছিল ।


অ্যাংরি ধাঁচের ক্রোধ হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রকাশ করেননি । ক্ষমতা ও প্রতাপের স্বরূপ উন্মোচনে যে পদক্ষেপগুলো হাংরি আন্দোলনকারীরা নিচ্ছিলেন, টেবিলের ওপরে তুলে দেয়া বিদ্যাসাগরের চটিপরা পায়ের মতন, সে কাজগুলো উল্টে ক্রুদ্ধ করে তলেছিল প্রতিষ্ঠানের বোড়ে-ঘোড়া-হাতি-উট-মন্তীদের, অ্যাংরি ওল্ড মেনদের । আধিপত্যের বিরুদ্ধে এরকম নিরবচ্ছিন্ন অভিযান বিটরাও শানাননি । অ্যাংরি রা সবাই ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক । বিটদের মধ্যে অ্যালেন গিন্সবার্গ ছাড়া সবাই ছিলেন আত্মকেন্দ্রিক । যে কোনো বুদ্ধিজীবির সততার পরীক্ষা হয় ক্ষমতাপ্রতাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে । অ্যাংরি ইয়াং ম্যানদের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্হী রাজনৈতিক মতামত এবং বিটদের কেবলমাত্র মার্কিন রাজনীতিকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ থেকে একেবারে আলাদা ছিল হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক মতামত ।


অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বিট জেনারেশানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠেনি । কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল । তাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মূলত সেকারণেই। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের কারণেই মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে গিয়ে তোলা হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের এই অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে মে ১৯৬৫ পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্ণিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুঁটিনাটি খবর সংগ্রহ করেছিল, এবং তাঁদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল খুলে ফেলেছিল, যেগুলো সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী লালবাজার পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স টেবিলের ওপরে দেখেছিলেন যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দপতর, পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারাল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্হ আধিকারিকদের নিয়ে গঠিত ইনভেসটিগেটিং বোর্ড সমীর ও মলয়কে জেরা করেছিল ।

সমীর ও মলয়ের জেরার পর, অ্যাডভোকেট জেনারালের পরামর্শে, রাষ্ট্রযন্ত্রটি মলয়ের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার মামলা করে, তাঁর প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার  কবিতাটির জন্য, এবং অন্তর্ঘাতের অভিযোগ তুলে নিয়ে অন্য সবাইকে রেহাই দ্যায় । এই ধরণের মামলার মুখোমুখি হতে হয়নি অ্যাংরি ও বিটদের । অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল কাব্যগ্রন্হটির বিরুদ্ধে মামলা করেছিল শুল্ক বিভাগ । অশ্লীলতার মকদ্দমার আগে থাকতে হাংরি প্রতিসন্দর্ভে ও জীবন যাপনে যৌনতার অভিযোগ উঠেছিল, কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল । অ্যাংরি ইয়াং ম্যান আর বিটদের মতন কেউই সমকামী ছিলেন না । সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষ একটি ছোট্ট ঘরে দুজনে থাকতেন এবং পরে মেসবাড়িতেও একই ঘরে দুজনে থাকতেন বলে তাঁদের সম্পর্কে অমন অপপ্রচার করা হয়েছিল । হাংরি বুলেটিনে সুবিমল বসাকের আঁকা  কয়েকটি স্কেচের কারণে, যেগুলো প্রথম দর্শনে কেউই বুঝতে পারেননি—লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ড ও কার্ল ওয়েসনারও পারেননি — হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রতিসন্দর্ভে যৌনতার অভিযোগ উঠেছিল । এটা ঠিক যে, হাংরি আন্দোলনকারীরা নারীকেন্দ্রিক যৌনহুল্লোড়ে অংশগ্রহণ করেছেন, কলকাতায়, বেনারসে, নেপালে । এ-ও ঠিক যে যাঁর সঙ্গে প্রথমবার শুয়েছেন, তাঁকেই বিয়ে করার প্রথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা । কিন্তু তাঁরা এসব ব্যাপারে বঙ্গসমাজে পায়োনিয়ার ছিলেন না । সুতরাং অ্যাংরি ও বিটদের সঙ্গে তাঁদের এ-ব্যাপারে এক গোত্রে ফেলা ভুল হবে ।

অ্যাংরি ইয়াং ম্যানরা মাদক নিতেন না । বিটরা নিতেন । প্রধানত উইলিয়াম বারোজ ও অ্যালেন গিন্সবার্গ, এবং নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন জ্যাক কেরুয়াক, যা তাঁরা নিতেন তাঁদের লেখালিখিকে বিশেষ আদল-আদরা দেবার অভিপ্রায়ে । হাংরি আন্দোলনকারীরা কেউই মাদকাসক্ত ছিলেন না, এমনকী ফালগুনী রায় ও নন । সুভাষ ঘোষ দিশি মদ খেতেন বটে, কিন্তু তা লেখার জন্য নয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মদ খাওয়া শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের আফিম খাবার মতন লেখার আউটপুট বৃদ্ধির জন্য ছিল না । সুভাষ মদ খেতেন কথোপকথনের আগল ভাঙার জন্য । বাসুদেব দাশগুপ্ত, ত্রিদিব মিত্র, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায় প্রমুখ, এল এস ডি, হেরোয়িন, মেসকালিন, অ্যামফিটেমাইন ইত্যাদি রাসায়নিক মাদক ট্রাই করেও দ্যাখেননি । হাংরি আন্দোলনের সময়ে শম্ভু রক্ষিত এখনকার মতন মদ খেতেন না । শৈলেশ্বর ঘোষ গাঁজা ফুঁকতে ভালোবাসতেন, তাঁর স্কুল-রাজনীতির টেনশান কাটাবার জন্য । হাংরি আন্দোলনে রাসায়নিক মাদকের পরিচয় করিয়েছিলেন করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ও অনিল করঞ্জাই, বেনারসের দুই পেইনটার । বিটদের প্রতিসন্দর্ভে মাদকের বিশেষ পরিসর ছিল । হাংরিদের একেবারেই ছিল না । অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি, কিন্তু সিগারেট পর্যন্ত খেতেন না । সমীর ও মলয়ের ছোটোবেলা কেটেছিল বিহারি অন্ত্যজ পাড়া ইমলিতলায়, যেখানের বাসিন্দাদের সকালের ব্রেকফাস্ট ছিল তাড়ি ; পাড়ার তাবৎ অনুষ্ঠানে তাড়ি ও সোমরস পরিবেশিত হতো ।

ধর্ম সম্পর্কিত প্রতিসন্দর্ভে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ও বিট জেনারেশানের যে অমিল ছিল, তার চেয়েও বেশি অমিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ছিল অ্যাংরি ও বিট কাউন্টার ডিসকোর্সের । ইস্ট কোস্ট ও ওয়েস্ট কোস্ট , উভয় এলাকাতেই বিট জেনারেশানের পত্রপত্রিকায় হাংরি ইশতাহারগুলো প্রকাশিত হলেও, ধর্ম সম্পর্কিত ইশতাহারটি তাঁরা প্রকাশ করেননি, তা সে সম্পাদক ইহুদি অথবা খ্রিস্টান, শ্বেতাঙ্গ অথবা কৃষ্ণাঙ্গ, পুরুষ অথবা নারী, যা-ই হোন, অর্থাৎ এই প্রতিসন্দর্ভের সাথে তাঁদের ঘোর বিরোধ দেখা দিয়েছিল, যদিও যে যার নিজের আরকাইভে তা সংরক্ষণের জন্য দান করে গেছেন । অ্যাংরিরা ধর্মে সমর্পিত ছিলেন, একেশ্বরবাদী ছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে ব্রিটিশ চার্চের বড়ো বেশি হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন । বিটদের, ইহুদি হোন বাখ্রিস্টান, সমস্যা ছিল একেশ্বরবাদের, যার উৎস সম্ভবত মার্কিন দেশে রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসন, যে কারণে সবাই আকৃষ্ট হয়েছেন বৌদ্ধধর্মের কোনো না কোনো শাখার প্রতি । হাংরি আন্দোলনের সময়ে ইশতাহারটি থেকে, এবং আন্দোলনকারীদের তখনকার জীবনযাত্রা থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তাঁরা ধর্ম সম্পর্কে বিরক্ত, আগ্রহহীন বা তার বাইরের বাসিন্দা । সুবো আচার্য অনুকুল ঠাকুরের শিষ্য হয়েছিলেন হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর ; দেবী রায় রামকৃষ্ণ আশ্রমের দিকে ঝুঁকে ছিলেন হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর । বলা চলে যে, আন্দোলনকারীদের জীবনে হিন্দু ধর্মের উপস্হিতি ছিল স্রেফ যে যার পারিবারিক প্যালিম্পসেট । ডক্টর বিষ্ণু দেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন যে তিনি ইন্সটিংকটিভলি হিন্দু, আচার-আচরণে নয় ।


কোনো কোনো আলোচক বিষয়টিকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণের প্রয়াস করেছেন । তাঁরা বলেছেন যে, জনাকয় লেখককে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান চিহ্ণিত করলেও, তাঁরা প্রকৃত অর্থে গোষ্ঠী ছিলেন না ; তাঁদের আপাতদৃষ্টিতে আসঞ্জনশীল মনে হবার কারণ তাঁরা সবাই খ্রিস্টধর্মী ও ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ । ক্রোধ প্রকাশ ব্যতীত তাঁদের নিজেদের মধ্যে আর কোনো মিল ছিল না । তাঁদের ক্রোধের উৎস ছিল ব্রিটেনে, বিশ্বযুদ্ধের কারণে, পুঁজিকাঠামোর রূপান্তর । উপনিবেশের সহায়তায় আবির্ভূত শিল্পবিপ্লবের চরিত্রে অকস্মাৎ মিলিটারি বাঁকবদল ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটেন । ফলত তার পুরোনো আধিপত্যবাদী পুঁজি তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, যা শেষাবধি প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তিতে ।


বিশ্বযুদ্ধের কারণে সর্বাধিক লাভ হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের । যুদ্ধে বিপর্যস্ত ইউরোপে কোনো দেশের পক্ষে আর পুঁজির নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব ছিল না । সুযোগের ফাঁকটি চুকিয়ে নিজের শিল্পদ্যোগকে কাজে লাগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । কমিউনিজম ভীতির দামামা বাজিয়ে শীতযুদ্ধ নামের আবহটি তারা এই জন্য সৃষ্টি করেছিল, যাতে সোভিয়েত রাষ্ট্র ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো মিলিটারি উদ্যোগে আটকে থাকে এবং সিভিল উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে না পারে । বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকা বিশ্বপুঁজির নেতা হয়ে ওঠে । বিট জেনারেশান ওই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্হার ফসল । বেশির ভাগ বিট কোনো চাকরি-বাকরি করতেন না । তাঁরা ধনী বাবা-মায়ের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন । খ্যাতিপ্রাপ্তির পরে তাঁদের বই, বক্তৃতা, আবৃত্তি, সাক্ষাৎকার, রেডিওটক, টিভিটক, ক্যাসেট ইত্যাদি সবকিছু তাঁরা বিক্রি আরম্ভ করেন । বিটরা হেলাফেলার মার্কিনী পোশাক পরা চল করেছিলেন যা পরে হিপিরা নকল করা আরম্ভ করেছিল । হাংরি আন্দোলনকারীরা সকলেই সাধারণ পোশাক পরতেন, কোনো বদল ঘটেনি তাঁদের পারিবারিক পোশাক ঐতিহ্যে ।বিট জেনারেশানের আসঞ্জনশীলতার উৎস হল মার্কিন পুঁজিবাদের রমরমা, যার প্রশ্রয়ে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের আয়ে দিব্বি বোহেমিয়ান আয়েস করতে পারতেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা এসেছিলেন অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে । সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী থাকতেন ইমলিতলা নামের বস্তিতে । দেবী রায় থাকতেন হাওড়ার বস্তিতে । শক্তি চট্টোপাধ্যায় থাকতেন উল্টোডাঙার বস্তিতে । সুবিমল বসাক থাকতেন পাটনার কুখ্যাত দুরুক্ষি গলিতে । সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী উদ্বাস্তু কলোনিতে থাকতেন ।


হাংরি আন্দোলনের উৎসের কারণ দ্বিমুখী । একদিকে স্বাধীণ ভারতবর্ষে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারতীয় পুঁজির নবরূপায়ণ, এবং অপরদিকে দেশভাগে পশ্চিমবাংলার পুঁজিকাঠামোয় তীব্র আঘাত ; প্রথমত পাটখেতগুলো পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হবার ফলে চটকলগুলোর ক্রমঅসুস্হতা, যা আর সারেনি, এবং দ্বিতীয়ত, অকস্মাৎ লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর আগমন, যা#দের জীবনে সৎমূল্যবোধ ও নীতি-ঐতিহ্যের পরিসর ছিল অসম্ভব, যে রোগ থেকে পশ্চিমবঙ্গ আর বেরিয়ে আসতে পাএনি । হাংরি আন্দোলনে তাই দুটি সমান্তরাল চিন্তাধারা বইতে দেখা গিয়েছিল । একটি ধারা তাঁদের যাঁরা দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবাংলায় এলেন । অপর ধারাটি তাঁদের যাঁরা দেশভাগের আগে থাকতে ভারতের বস্তি এলাকায় বসবাস করতেন । এই দুটি ধারাতেও বিভাজন ছিল বর্গের, বর্ণের, সামাজিক পৃষ্ঠপটের, পারিবারিক ঐতিহ্যের, পঠনপাঠনের, বাড়ির কথ্যবুলির, নিবাসগৃহের, পরিবেশের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, নিজস্ব আয়ের, এবং আরও বেশকিছু প্রতিস্ব-নির্মাণ উপাদানের । হিন্দি ভাষার কবি রাজকমল চৌধুরী বলেছিলেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা একটি কোহেসিভ গোষ্ঠী নয় এবং গোষ্ঠীটি কোহেসিভ নয় বলেই আন্দোলন তীব্রতা পেয়েছিল, মাত্র পাঁচ বছরের সময় পরিসরে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক এসট্যাবলিশমেন্টকে ।


১৯৬২ সালে সম্প্রতি  পত্রিকায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে লেখার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই তিনটি প্রতিসন্দর্ভের বৈভিন্ন্য এভাবে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন : “বিদেশে সাহিত্যকেন্দ্রে যেসব আন্দোলন বর্তমানে হচ্ছে, কোনটি বিট জেনারেশান, অ্যাংরি বা সোভিয়েত রাশিয়াতেও সমপর্যায়ী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বাংলাদেশেও কোনো অনুক্ত বা অপরিষ্কার আন্দোলন ঘটে গিয়ে থাকে, তবে তা আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশে ‘ক্ষুধা সংক্রান্ত’ আন্দোলনই হওয়া সম্ভব । ওদিকে ওদেশে সামাজিক অবস্হা অ্যাফ্লুয়েন্ট, ওরা বিট বা অ্যাংরি হতে পারে । আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত । যে-কোনো রূপের বা রসের ক্ষুধাই একে বলতে হবে । কোনো রূপ বা কোনো রসই এতে বাদ নেই, বাদ দেওয়া সম্ভব নয় । একে যদি বিট বা অ্যাংরি দ্বারা প্রভাবিত বলার চেষ্টা হয় তবে ভুল বলা হবে । কারণ এ-আন্দোলনের মূলকথা সর্বগ্রাস।”

এই রচনাটির জন্য হাংরি, অ্যাংরি ও বিট প্রতিসন্দর্ভের বৈভিন্ন্য নির্দেশ করে অরবিন্দ প্রধান এই তালিকাটি তৈরি করেছেন :

হাংরি………………………..অ্যাংরি……………………বিট

খেদ………………………….ক্রোধ………………………উন্মাদনা

সাতরঙা……………………রঙহীন……………………একরঙা

হিন্দু অথচ আগ্রহহীন…….প্রটেস্ট্যান্ট………………..ইহুদি,খ্রিস্টান,বৌদ্ধ,মুসলমান

ব্যক্তিক নেশা………………মদ্যপ………………………মাদকাসক্ত

অনির্বাচিত মানবস্বভাব..স্বাভাবিক মানবস্বভাব..নির্বাচিত মানবস্বভাব

দক্ষযজ্ঞ……………………দক্ষতা………………………দক্ষবিরোধ

অপ্রত্যাশিত……………..প্রত্যাশাহীন………………..প্রত্যাশিত

ইউনিসেক্সুয়াল…………হোমোসেক্সুয়াল……………..হেটেরোসেক্সুয়াল

অনুস্তর…………………উচ্চস্তর………………………..সর্বস্তর

কালোমানুষ…………..ধলামানুষ……………………..মিশ্রমানুষ

বহুস্বর………………..একস্বর…………………………..দ্বিস্বর

যৌগিকরূপ………….একরূপ…………………………..বহুরূপ

প্রান্তিক………………..কেন্দ্রিক…………………………কেন্দ্রবিরোধী

বহুপরত সংস্কৃতি….একপরত সংস্কৃতি……………দুইপরত সংস্কৃতি

ভঙ্গুর আত্মপরিচয়…কেলাসিত আত্মপরিচয়……নির্মিত আত্মপরিচয়

স্হানিকতা…………..কালানুক্রমিকতা…………..অনুক্রমবর্জিত কাল

সংজ্ঞা দখল…………সংজ্ঞা অনুসরণ…………….সংজ্ঞা নির্মাণ

ম্যান…………………ব্যাটম্যান……………………..স্পাইডারম্যান

পরিপূরকের ঔচিত্য…বৈপরীত্যের বিপন্নতা…..স্বয়ম্ভূ

দুই সীমালঙ্ঘন…….সীমারক্ষা…………………….নিম্ন সীমালঙ্ঘন

মুক্তধারার সৃষ্টি…..বাঁধভাঙার দুঃখ…………….মুক্তধারার খোঁজ


হাংরি আন্দোলন বহুকাল আগে ফুরিয়ে গেছে । যাঁরা আন্দোলনটি আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা কেউই হাংরি অভিধা দ্বারা আর সীমায়ীত নন । কিন্তু তার পর থেকে প্রায়ই এদিক-সেদিক এখান-ওখান থেকে হঠাৎ-হঠাৎ অতিতরুণরা, যাঁরা দেশভাগের উদ্বাস্তু পরিবারপ্রসূত, নিজেদের হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে ফ্যালেন, তার কারণ বঙ্গসমাজের পুঁজিকাঠামোটি, মারাঠি-গুজরাতি-কর্ণাটকি-পাঞ্জাবি সমাজের তুলনায়, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গেছে । তরুণ কবিরা আজও মলয় রায়চৌধুরীকে অনুরোধ করেন আন্দোলনটি আরেকবার তার আগুন নিয়ে সমাজের বুকে আবির্ভাব হোক, এবং তিনি নেতৃত্ব দিন । হাংরি আন্দোলন যে রণন সৃষ্টি করে দিয়েছিল তাতে ওই অতিতরুণরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন, একথা জেনে যে বর্তমান বঙ্গীয় অবস্হায় কোনো সাহিত্য আন্দোলন আর সম্ভব নয় । তার কারণ হাংরি ছিল একটা জ্ঞান-পরিসর, প্রতিসন্দর্ভের জ্ঞান-পরিসর, যা অ্যাংরি ও বিট পরিসর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল ।




Sunday

করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের আঁকা হাংরি পোস্টার-বুলেটিন






Hungryalist Poster drawn by Karunanidhan Mukhopadhyay during the sixties. This poster was pasted on the wall of Kolkata College Street Coffee House which had enraged a group of Establishment writers and artists.

Thursday

বিষয়টি নিয়ে আমার কথা

সমীর রায়চৌধুরী

প্রথম পঞ্চবার্ষিক যোজনায় ( ১৯৫১-৫৬ ) কৃষি, সেচ, পথঘাট নির্মাণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে জোর দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ আর দেশভাগ বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্বাসন। অর্থাৎ ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকারের খেসারতের ভার থেকে ক্রমমুক্তি। কর্মসংস্হান বৃদ্ধি আর খাদ্য সমস্যার সমাধান। সাফল্য জোটে আশাতীত। জাতীয় আয়ের লক্ষমাত্রা ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৮ শতাংশে পোঁছোয়। মাথাপিছু ভোগ্য ব্যয় বাড়ে কুড়ি শতাংশ মাথাপিছু ভোগ্যব্যায় বাড়ে আট শতাংশ। খাদ্যশষ্যের উৎপাদন বেড়ে যায় কুড়ি শতাংশ। পেনিসিলিন কারখানা, তেল পরিশোধন, রেল লাইন পাতার কাজ হয় পাশাপাশি। আমজনতা এই কর্মকাণ্ড আত্মসাৎ করে সহজ স্বাভাবিকতায়। কেননা দেশের কৃষিভিত্তিক, কুটির ও ক্ষুদ্রশিল্প নির্ভর অবস্হানপন্নতার সঙ্গে 'আগরওয়াল মডেল'-এর ধাঁচে তৈরি এই যোজনার আত্মিক যোগ ছিল।
        রবীন্দ্রনাথ সোভিয়েত ইউনিয়ন ঘুরে এসে এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা নেহেরুকে জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর নেহেরুর নেতৃত্বে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়। শুরু হয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। এই সময় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দেশের চৌতরফা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রিজার্ভ ব্যাংক, কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য সরকারগুলোর দৃষ্টিকোণ ও বিন্যাসের দ্রুত পরিবর্তন আর বিস্তার ঘটতে থাকে। দ্বিতীয় পরিকল্পনার আদর্শ ছিল পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে 'জোর ধাক্কা' । এই 'জোর ধাক্কা'-র দৃষ্টিকোণ থেকে ড্রাইভ, স্পেশাল ড্রাইভ, ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, সবুজ বিপ্লব, অপারেশান ইত্যাদি দ্রুতমুখী পরিকল্পনার নানাবিধ ছকগুলো ক্রমাগত বেরিয়ে আসে।
        দ্বিতীয় যোজনা ( ১৯৫৬-৬১) অনেকটা সরে যায় 'বোম্বাই মডেল'-এর দিকে। এই যোজনায় জোর দেওয়া হয় বৃহত্তর শিল্পায়নের দিকে। সমাজসেবার খাতেও ব্যয়মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি উদ্যোগে বৃহৎশিল্পের পত্তনের জন্য তিনটে ইস্পাত কারখানা স্হাপনের জায়গা বেছে নেওয়া হয় দুর্গাপুর ভিলাই আর রাউরকেলায়। কৃষি এলাকার ব্যর্থতা আর খরা পরিস্হিতির দরুণ খাদ্যশস্যের দাম বাড়তে থাকে। অব্যহত থাকে দেশভাগজনিত ছিন্নমূল মানুষের আগমন। দেশভাগজনিত ছিন্নমূল মানুষের জীবিকার প্রয়োজনে জোর দেওয়া হয়েছিল বৃহত্তর শিল্পায়নের দিকে। অথচ এই শিল্পায়নের জন্য জায়গা বেছে নেওয়া হয় আদিবাসী আর অন্ত্যজ শ্রেণীর গ্রামগুলোয়; উচ্ছেদ করা হয় স্হানীয় অধিবাসীদের। ফলে এক ছিন্নমূলের পুনর্বাসনের আয়োজন করতে গিয়ে নতুন ছিন্নমূল মানুষজন দেখা দিল। বাড়তে থাকে উত্তরঔপনিবেশিক প্রত্যাঘাত। দেখা দেয় বিশ্বব্যপী মুদ্রাস্ফীতি । যার কোপ পড়ে এদেশেও। তৃতীয় তরঙ্গের বিজ্ঞানদর্শন ও প্রযুক্তি দ্বিতীয় তরঙ্গের বিজ্ঞানপ্রযুক্তির ত্রুটিগুলোর দিকে ক্রমশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে । ফলে আধুনিকতার খেসারতগুলো নিয়ে নানা দিক থেকে ভাবনা চিন্তা বিশিষ্ট ভাবুকদের বিচার-বিশ্লেষণে বাধ্য করে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর উত্তরঔপনিবেশিক পরিস্হিতিতে এই ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে দেশে বিদেশের সাহিত্য-শিল্পের পরিসরে। সরাসরি যার প্রভাব পড়ে প্রত্যেক ভাষায়, সাহিত্য শিল্প নিয়ে যাবতীয় ভাবনাচিন্তায়। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক যোজনার মুরোদ ফুরোলে খাপ খুলে বেরিয়ে পড়ে হাংরি জেনারেশান। ভৌমতা ও স্হানিকতার প্রসঙ্গ উঠে আসে। কথা উঠতে থাকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বদলে নীচে থেকে গড়ে ওঠা কর্মকান্ডের বিন্যাস নিয়ে। ঔপনিবেশিক খেসারত বাবদ ভারত-চীন যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এই সব ঘটনা ঘটতে থাকে। হাংরি আন্দোলন কাগজে কলমে শুরুহয় ১৯৬১-এর নভেম্বরে, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা দানা বাঁধতে থাকে ঢের আগে। মলয় অর্থনীতির ছাত্র থাকার সময় থেকেই এমন একটা বিষয় নিয়ে নানা দিক থেকে তার সঙ্গে আলোচনা চলত।
        পাটনায় আমরা থাকতাম কাহারটোলা ইমলিতলা পাড়ায়, গরিব মুসলমান ও বিহারি অন্ত্যজদের এলাকায় ; পরে বাবা বাড়ি কেনেন নিচলকি সড়ক দরিয়াপুরে। স্বাধীনতার পর নিচলকি সড়কের নাম হয় আবদুল বারি রোড । এদেশে স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক কারণে তাঁর নিজের দলের লোকজনদের হাতে প্রথম খুন হন এই আবদুল বারি। সেই সময় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা। বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হতেন। যথারীতি তা নিয়ে তদন্ত কমিশন বসে। প্রথম রাজনৈতিক হত্যা আর প্রথম তদন্ত কমিশন। তারপর তো একের পর এক তদন্তের হিড়িক আমরা দেখেছি। সেসব তদন্তের ফাইনাল রিপোর্ট পচতে থেকেছে সরকারি মহাফেজখানায়। আবদুল বারিকে আমরা চিনতাম ছোটোবেলা থেকে। তিনি মাঝে-মাঝে বি এন কলেজের সামনে বাবার ফোটোগ্রাফির দোকানে আসতেন। এই ফোটোগ্রাফির দোকান পাটনার অন্যতম কলেজের ঠিক সামনে থাকায় আর বাবার আড্ডা দেওয়ার মেজাজের জন্য বড়োসড়ো জটলার ঠেক হয়ে ওঠে।
        ইমলিতলায় থাকার সময়ে আমি নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতাম প্রফেসার্স লেনে, দরিয়াপুরে, যেখানে আমার স্কুলজীবনের বন্ধুরা থাকত। ভাস্করের বাবা সাহিত্যিক মানিক ভট্টাচার্য, বুজলুর বাবা বিশিষ্ট ভাবুক বিমানবিহারি মজুমদার প্রমুখ; সেই সূত্রে তখন তাঁরা ছিলেন আমাদের যৌথতার অভিভাবক। কাছেই রাজেন্দ্রনগরে থাকতেন হিন্দি সাহিত্যিক ফণীশ্বরনাথ রেণু আর কবি রামধারী সিংহ দিনকর। দুই লেখক স্বয়ং নামের পাশে যোগ করেছেন, 'রেণু' ও 'দিনকর' নতুন পদবি। একজন নিম্নবর্গ পরিচিতি বাতিল করেছেন আর অন্যজন উচ্চবর্গ পরিচিতি বজায় রেখে তাঁর উদারবাদী দৃষ্টিকোণ সংযোজন করেছেন। উভয় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সাবেকি জাতপাত প্রথা থেকে সরে আসার সাহিত্যিক-মেজাজি ঝোঁক। বর্ণপ্রথার মেটাথেসিস। সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্হানে দুটি দিক থেকে উৎপন্ন পরিবর্তনকামী প্রকরণ। ফণীশ্বরনাথকে নিয়ে কৃত্তিবাস পত্রিকার একটি পৃথক সংখ্যা সুবিমল বসাক-এর সহযোগীতায় পরবর্তীকালে সম্পাদনা করি। তিনি ছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। বন্ধু রাজকমল চৌধুরীর উদ্যমে হাংরি আন্দোলনের হিন্দি সংস্করণ 'ভুখী পীঢ়ী' যেজন্য সহজেই প্রসারিত হয়। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশ্বজিত সেন-এর বাবা প্রখ্যাত মার্কসবাদী নেতা ও ভাবুক অশোক সেন থাকতেন রাজেন্দ্রনগরে। মাঝে-মাঝে দ্বারভাঙা থেকে আসতেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। বাবার কাছে তাঁর ফোটোগ্রাফির দোকানে আরো আসতেন শীলভদ্র যাজী, কৃষ্ণবল্লভ সহায়, রাজেন্দ্র প্রসাদ, প্রমুখ ছাত্ররা--- যাঁদের ভূমিকা পরবর্তীকালে ক্রমশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
        স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে মা-এর আগ্রহে চলে আসি মামারবাড়ি পানিহাটিতে। কলকাতায় সিটি কলেজে পড়ার সময় যুক্ত হই কবি, গল্পকার, তরতাজা তরুণ সাহিত্যিকদের কর্মকাণ্ডে; যেমন কৃত্তিবাস আর নাটকের দল 'হরবোলা'তে। সেই সময় পানিহাটিতে ছোটোমামা বিভাস বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছিলেন অর্থনীতি নিয়ে। যে কোনো বিষয়কে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে গুছিয়ে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করতেন তিনি। অথচ আমাদের দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল সামান্য। তিনি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। ফলে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে মলয়কে রাজি করাই। বাবা-মা সন্মতি দেন। মলয় অর্থনীতিতে সান্মানিক স্নাতক ও এম এ পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো ফল করে। তার বিশেষ আগ্রহ গড়ে ওঠে ভারতীয় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর সংস্কৃতিক পরিস্হিতি সম্পর্কে। পাশাপাশি আমার আগ্রহে সে লেখালিখিতে মনোযোগ দেয়। আমার পড়াশুনার বিষয় ছিল বিজ্ঞান।
        ইমলিতলা, দরিয়াপুর, পানিহাটি ইত্যাদি জায়গায় আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যবধানের দিকগুলো ক্রমশ এলোমেলোভাবে চোখে পড়তে থাকে। আমার লেখার সঙ্গে মলয়ের লেখাপত্তর কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের হাতে প্রকাশের জন্য দিতে থাকি। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বিকাশপর্বে জ্ঞানচর্চার নতুন নতুন দিক তখন উঠে আসছে। পড়াশুনা শেষ করে মলয় রিজার্ভ ব্যাংকে আর আমি রাজ্য সরকারের চাকরিতে ঢুকি। মলয় শিলং ও ভাগলপুরে গোড্ডা কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পেয়েছিল, কিন্তু বাবা পাটনার বাইরে যেতে দিতে রাজি হননি। চাইবাসার একটি কলেজেও মলয় ইনটারভিউ দিয়েছিল কিন্তু পদটি আগে থেকে অন্যজনের বরাদ্দ ছিল। লোকদেখানো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল কাগজে। পাটনার বাইরে অনেক জায়গায় আমিও চাকরি পেয়েছিলাম। যেমন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একসাথে পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় চাকরি পেয়েছিলাম পুনর্বাসন বিভাগে; পৃথক পরীক্ষা দিয়ে পর্যটন বিভাগে।
        মলয় ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে এম এ করার পর তার প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি ( মার্কসবাদের উত্তরাধিকার ) তৈরি করে। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে দিয়েছিলেন প্রফেসার্স লেনের অভিভাবক মহল। পাণ্ডুলিপি নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছিলাম, এবং তাঁরা অবাক হয়েছিলেন দৃষ্টিকোণের অভিনবত্বে। মার্কসবাদ প্রয়োগের দিক থেকে এখন যে জায়গায় পৌঁছেচে তার যথেষ্ট পূর্বাভাস ছিল মলয়ের সেই লেখায়। সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ে স্হানীয় বিদ্বজ্জনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ফলে কলকাতায় গিয়ে সেখানকার বন্ধুদের মতো বিদ্যায়তনিক ভীতির কবলে পড়িনি।
        ইতিমধ্যে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্হ 'ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি' এবং তারপর 'আমার ভিয়েৎনাম'। ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে বেরোয় মলয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্হ 'শয়তানের মুখ'। এসবের ঢের আগে আমার উদ্যমে প্রকাশিত হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর প্রথম কাব্যগ্রন্হ 'একা এবং কয়েকজন'। এই সমস্ত ঘটনাই ঘটতে থাকে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে।
        হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রদীপ চৌধুরী, সুবিমল বসাকঅরুণেশ ঘোষ ঘনিষ্ঠতার সূত্রে 'নিমসাহিত্য আন্দোলন'-এর পত্রিকাগুলোতে অনায়াসে লিখেছেন । আবার কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আন্দোলনের দৃষ্টিকোণ থেকে 'হাংরি জেনারেশান'-এ যোগ দিয়েছেন। হাংরি আন্দোলনে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা কেউ কৃত্তিবাস ও হাংরি আন্দোলনকে সমগোত্রীয় মনে করেননি।
        আমার গল্প কবিতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে দীপ্তি ত্রিপাঠী সেসময়ে লিখেছিলেন--- "সমীর রায়চৌধুরীর লেখায় দেখা যাচ্ছে অসংল্গনতা ও যুক্তির অনুক্রমের অভাব"। বস্তুত তিনি বলতে চেয়েছিলেন টেক্সটের উপস্হাপনে সময়কেন্দ্রিকতার অভাব আর পরিসরমুখীনতার প্রাধান্য সম্পর্কে। যুক্তির বহুমুখীনতার প্রসঙ্গকে তিনি প্রকারান্তরে 'অসংলগ্নতা' হিসাবে শনাক্ত করেন। কবিতার পাশাপাশি কবিতার কাগজ কৃত্তিবাস পত্রিকায় আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়-- তার আগে কৃত্তিবাস পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়নি। এই গল্প ছিল কৃত্তিম প্লট-বর্জিত এবং সময়কেন্দ্রিকতা-বর্জিত।
        মলয়ের লেখাতেও এমনই সব লক্ষণ ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সথক্ষ্মতর হয়ে ওঠে। ইমলিতলা পাড়ার অবস্হানপন্নতা আর তার মিশনারি ও ব্রাহ্মসমাজ স্কুলে পড়াশুনা, পরে অর্থনীতি নিয়ে এম এ পড়া এবং রিজার্ভব্যাংকে চাকরিতে ঢোকার ফলে জীবনের যাপিত অভিজ্ঞতা ও অধ্যয়ন থেকে এই লক্ষণগুলো স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। মলয় পরবর্তীকালে কৃষি ও গ্রামীণ বিকাশ বিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্হা 'নাবার্ড'-এর ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজারের পদে কলকাতা থেকে অবসর নেয়। চাকুরিসূত্রে মলয়কে গ্রামে-গ্রামে যেতে হতো চাষি, তাঁতি, জেলে ইত্যাদি পেশার মানুষদের উন্নতি করার পথসন্ধান করতে।
        ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কাগজে-কলমে মুক্তি পাওয়ার পর হাতেনাতে সেই মুক্তি প্রতিষ্ঠার দায় প্রবলভাবে অস্হির রাখে। সঙ্গে থেকে যায় ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া খেসারতগুলো। মাথা চাড়া দেয় আত্মবিচ্ছেদগ্রস্ত সত্তার নিজস্ব ভৌমতা তল্লাশির অনিবার্যতা। এই মুক্তির পাশাপাশি কাজ করে আরও এক অনিবার্যতা। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্রোতে শামিল হওয়ার সমীকরণ । এই সমগ্র আলোড়ন শেষমেশ আত্মসাৎ করার দায় ভাষার; যাবতীয় পরিবর্তনের গর্ভস্হল। সাহিত্য সেই প্রকৃতিস্হ প্রসবাগার। ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে মুক্তির আগ্রহে উত্তরঔপনিবেশিক পরিস্হিতিতে প্রত্যেক ভাষায় উঠে এসেছে এমনই সব প্রবল আন্দোলন। বাংলা ভাষা তার ব্যতিক্রম নয়। পর পর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনএকের পর এক ভাষাদেশে কাজ করে গেছে। হাংরি আন্দোলন বাংলা সরেজমিনে যাবতীয় আন্দোলনের জমি তৈরি করে দিয়েছে।
       বিশ্বপ্রকৃতির সব আয়োজনে কাজ করে চলেছে পার্থক্য আর ঐক্যের বহুমুখী অন্তর্বাহী স্রোত। ব্যক্তি বা লেখকের স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাতিস্বিকতার জায়গায় আন্দোলন অনেকের একত্রিত যোগপ্রক্রিয়াকে সচল রাখে। যাঁরা কেবল নিজস্ব প্রতিষ্ঠা অর্জনে মগ্ন সেই সব প্রাতিষ্ঠানিকতা অনুগত লেখক বা আলোচকের আন্দোনের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হওয়াই স্বাভাবিক।
        প্রথম দিকে চারজন মিলে ( আমি, মলয়, শক্তি ও দেবী রায় ) আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটালেও, এই চারজন প্রত্যেকের যে পৃথক ঘনিষ্ঠ মহল ছিল তারা একে একে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনের কাঠামো ছিল খোলামেলা, ফলে যোগ দেওয়ার শর্ত ছিল অবাধ। বয়সের তফাত ছিল প্রত্যেক ঘনিষ্ঠমহলের, প্রথম থেকে যে-জন্য দশকভিত্তিক জটলা বা গোষ্ঠীমুখীনতা প্রশ্রয় পায়নি। হাংরি আন্দোলনে যারা এক এক করে যোগ দিয়েছেন, এমনকী যোগ দিয়ে পরে সরে গেছেন তাদের প্রত্যেকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে এই পার্থক্য আর ঐক্যের এই সমীকরণে আর কাঙ্খিত অবস্হানপন্নতার ক্রমনির্মাণে।
        যেহেতু লেকক প্রতিস্ব থেকে আন্দোলন নজর ঘোরায় টেক্সটের প্রাধান্যের দিকে অতএব যাঁরা কেবল নিজের ব্যক্তিপ্রতিস্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁদের সরে যাওয়া ছিল খুব স্বাভাবিক। আন্দোলনের চরিত্রবল তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না। এখন তো বিদারগ্রস্ত হওয়ার উত্তরঔপনিবেশিক অবস্হানপন্নতার ঔচিত্য সকলের কাছে ঢের স্পষ্ট।
        একসময় প্রফেসার্স লেনের আর অন্যান্য 'ভদ্র' এলাকার বন্ধুরা আমার ইমলিতলার বন্ধুদের বলত 'ছোটোলোক'। অবশ্য ছোটোলোকদের অনেকের কন্ঠস্হ ছিল 'রামচরিতমানস', সে তুলনায় ভদ্র বন্ধুদের অনেকে রবীন্দ্রনাথের কোনো দীর্ঘ কবিতা মনে রাখার চেষ্টা করত না। তারপর দেখি ইমলিতলার শনিচ্চর রাম-এর ছেলে মন্ত্রী হল, যে শনিচ্চর চাচাকে কেউ আমল দিত না তিনিও একটু-একটু করে হয়ে গেলেন ভিআইপি। এখন তো তাদের ছেলেপুলেরা শনিচ্চরজীর ছেলেকে বলে নেতাজী। প্রফেসার্স লেনের ভদ্র পরিবেশে প্রায়দিন নাটক, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। ইমলিতলার বন্ধুরা লুকিয়ে-চুরিয়ে পাঁচিলের ওপার থেকে দেখে আসত। অনুষ্ঠানের শেষে পুরস্কার বিলোনো হতো। সে আরেক মজা। সুবিমল বসাক-এর পাটনাই বুলির গল্পে এমন বিস্তর মজা আছে। একজন রিকশাঅলা রাত বাড়লে তার রিকশায় বসে উত্তুরে হাওয়ার দিকে মুখ করে আপন মনে 'বিরহা'-র মস্তিতে বাঁশি বাজাত। তার বাঁশি রাগ-অনুরাগের মধ্যে তফাত জানত না। যারা শুনতে পেত তাদের মনের মধ্যে অবস্হানপন্নতার জৈবপ্রক্রিয়া অস্হির হয়ে উঠত। ভাস্কর ছিল মেঠো মার্কসবাদী। তার নিজস্ব সব মতবাদ ছিল, যেমন: লগ্নিকারীরা কলকারখানা এটা-সেটায় অর্থনিবেশ করে আর লগ্নিবাবদ মালিকানার হক বজায় রাখে, তেমনি কবি-লেখকরাও শব্দমহলের জমিনে আনকোরা অর্থনিবেশ করে তার টেক্সটের মালিকানাসত্ত্ব দাবি করে। মলয় তাঁর কোনো টেক্সটের কপিরাইটের অধিকার রাখেনি। মলয় বিশ্বাস করেনি টেক্সটের এই ধরনের মালিকানায়। অনায়াসে ফিরিয়ে দিয়েছে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। যে অকাদেমি পুরস্কারের জন্য বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই সক্রিয় ও লালায়িত থাকতে আর কলকাঠি নাড়তে দেখেছি।
১৯৫৯ সালে চাইবাসায় যখন চাকুরি করতাম, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার নিমডির বাসায় আসে। আমি যেখানে-যেখানে চাকুরিসূত্রে থেকেছি বন্ধুরা সেই সব জায়গায়, যেমন ডালটনগঞ্জ, ধানবাদ, চাইবাসা, দুমকা, পুর্ণিয়া, মুঙ্গের, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, পাটনা ইত্যাদি স্হানে তাঁরা প্রায় সকলেই এসেছেন--- বিয়ের পরে সস্ত্রীক। কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত বন্ধুরা এসেছেন আবার হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত লেখকরা সমানভাবে এসেছেন। এমনকী এসেছেন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত লেখকরা ও কলকাতার বিভিন্ন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ।একটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিশ্চিত রেখে তার গ্রাহ্যতার পরিবেশ গড়ে তোলা, আর সেইভাবে লেখায় মনোযোগী হওয়ার অর্থ এই নয় যে তার বাইরে সাহিত্যের আর সব এলাকার অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা হবে না। সম্পর্কের পরিধি বাড়ানো আন্দোলনের দিক থেকে আরও জরুরি। একটি আন্দোলনের ঔচিত্য কাজ করে অবস্হানপন্নতার প্রেক্ষিতে। কোনো আন্দোলনই দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন হয় না। দীর্ঘকাল টিকিয়ে রাখার অর্থ অবস্হানপন্নতার গতিময়তার প্রতি উদাসীন থাকা। কাগজে-কলমে হাংরি সূচীতে নাম না উঠলেও এই অবলোকন ভঙ্গী প্রভাবিত করেছে তার বাইরের পরিসরও।
        চাইবাসায় এসে শক্তি দীর্ঘকাল আমার বাসায় থেকে যায়--- প্রায় তিন বছরের কাছাকাছি। এখানেই প্রথম তিনটি গ্রন্হের পাণ্ডুলিপির খসড়া তৈরি করে। সারাদিন কবিতা, কবিতার ভাষা, গল্পের ভাষা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চালাত। চাইবাসার নিমডি পাড়ার হো-সাঁওতাল গ্রামের একটি টিলার ওপরে চালার বাড়িতে আমরা থাকতাম। চাইবাসা এবং চাইবাসার একজন  তরুণী শক্তির কবিতায় বারবার উঠে এসেছে। এই তরুণীর জন্যই শক্তি চাইবাসায় অতকাল থেকে গিয়েছিল। এমনকী পৃথকভাবে শক্তির লেখালিখিতে 'চাইবাসাপর্ব' হিসেবে সেই টেক্সটগুলোকে শনাক্ত করা যায়।
        মলয়ের সঙ্গে 'হাংরি আন্দোলন' শুরু করা নিয়ে যেসব বিষয়ে আলোচনা হত সেগুলো নিয়েও কথাবার্তা চলত শক্তির সঙ্গে। প্রায় একই পরিবেশ থেকে উঠে এসেছিল শক্তি। যখন চাইবাসায় আসে তখন কলকাতায় শক্তি নিজের মাকে নিয়ে থাকত উল্টোডাঙার বস্তি এলাকার কাছে একটা বাড়িতে । সেবাড়িটায় অনেক ঘর ভাড়াটে ছিল-- প্রত্যেকের একটা ঘর আর রান্নার জায়গা। ঘরের মধ্যে চৌকি দিয়ে একতলা-দোতলা স্পেস তৈরি করা হয়েছিল। শক্তির মামার বাড়ি ছিল ঢের সচ্ছল। অর্থাৎ দুটো জীবনেরই যাপিত অভিজ্ঞতা তার ছিল। তবে উল্টোডাঙার সেই বাড়িতে শক্তি কখনও কোনো বন্ধুকে নিয়ে যায়নি। অথচ প্রথম আলাপেই আমাকে নিয়ে যেতে তার কোনো দ্বিধা বোধ হয়নি। চাইবাসায় থাকার সময়ে শক্তিকে নিয়ে কয়েকবার পাটনা গিয়েছি। সেখানে মলয়ের সঙ্গে তার পরিচয় ও কথাবার্তা হয়েছে। হাংরি আন্দোলন নিয়ে মাঠে নামার বিষয়ে কথাবার্তা হয় শেষবারে । পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতি শক্তির আগ্রহ ছিল স্বাভাবিক। যেজন্য হাংরি আন্দোলনের নেতৃত্ব নিতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। আমাদের প্রস্তাব সহজে গ্রহণ করেছিল।
        হাংরি আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তাবোধের অভাব, প্রেমিকার অভিভাবক দ্বারা প্রত্যাখ্যান, চাকরির শর্ত, কলকাতার পুরোনো বন্ধুদের চাপ, প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতির মোহ ইত্যাদি ক্রমশ হাংরি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হয়ে থাকার প্রতি তার দৃষ্টিকোণ বদলে দিতে থাকে। কলকাতা থেকে দূরে-দূরে থাকার জন্য যা প্রথমটা আমি আঁচ করতে পারিনি। অবাক হই হাংরি মামলায় শক্তির সরকারপক্ষে সাক্ষ্য দেবার সময়। শক্তি আমাকে বা মলয়কে আগে থেকে জানায়নি যে ও সরকারী সাক্ষী হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে শক্তির মধ্যেও ব্যক্তিগত সংকোচ ছিল। কিন্তু এই সংকোচের চেয়ে বড়ো ছিল আর সব কারণগুলো।
        হাংরি আন্দোলনের যে জায়গাটা শক্তিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল সেটা মূলত তার অবস্হানপন্নতা। কেবল শক্তি নয়, চাইবাসা পর্ব অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে। যেমন সুনীলের 'অরণ্যের দিনরাত্রী', চাইবাসায় আসা বন্ধুদের নিয়েই লেখা। হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাতের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্হিতি আন্দোলনের পক্ষে যথেষ্ট অনুকুল ছিল। কিন্তু অনুকূল ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক সাংস্কৃতিক পরিস্হিতি। হাংরি আন্দোলনের বিরোধ দেখা দেয় এই জায়গা থেকে। হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কবি-লেখকেরা ভাষাদেশে যে পরিবর্তন এনেছেন, তাকে এক কথায় প্রকাশ করা যায় 'মেটাথেসিস' শব্দের মাধ্যমে। 
        মেটাথেসিস শব্দের পূর্বে অর্থ ছিল 'শব্দের অন্তর্গত বর্ণবিশেষের স্হান পরিবর্তন। পরে এই শব্দ প্রয়োগ করা হয় জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন এলাকায় পরিবর্তনের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে, উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎসে। অর্থান্তর ঘটে প্রয়োগে, শব্দার্থের ভৌগলিকতায় আর ভাষানকশার পরিবর্তনে। ঔপনিবেশিকতা প্রশ্রয় দিয়েছিল কলাকেবল্যবাদ ও দ্বিমুখী বৈপরীত্যবোধ। হাংরি আন্দোলনে যুক্ত কবি-লেখকেরা এই মানদণ্ডগুলো আদৌ মেনে নেন নি এবং তাকে কার্যকর করা তুলেছেন তাদের নিজেদের টেক্সটে। কাব্যগ্রন্হের নাম 'জখম' বা 'চর্মরোগ' রেখেছেন অনায়াসে। এমন সব শব্দ, শব্দজোট, শব্দসম্পর্ক তারা গড়ে তুলেছেন যা ইতিপূর্বে অনুমান করা সম্ভব ছিল না। টেক্সটের চরিত্রবলের ধরতাই আমূল পালটে গেছে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সূত্রে। পরবর্তী প্রজন্মগুলো আরও সক্রিয় হয়েছে নতুন-নতুন প্রয়োগে। কেজো এবং বর্জনীয় এই দ্বিমুখী জায়গা থেকে সরিয়ে দেয় মেটাথেসিসের দৃষ্টিকোণ। হাংরি আন্দোলনের ফলেই পরবর্তী আন্দোলনগুলোর স্বাভাবিকতা ও বহুমুখীনতা গড়ে উঠতে অসুবিধা হয়নি। হাংরি আন্দোলনের আরেকটি দিক লিটল ম্যাগাজিনের বিস্ফোরণের সূত্রপাত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মলয়ের হাংরি বিষয়ক প্রবন্ধগুলো 'হাওয়া৪৯' এর বিশেষ 'হাংরি আন্দোলন' সংখ্যায় সংকলিত করা হয়েছে। যেমন হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে বিট, অ্যাংরি ইয়াং ম্যান ইত্যাদির তুলনা করা হয়। অথচ ধারণাগুলো অজ্ঞতাপ্রসূত। প্রথম ধাপ হল মলয়ের প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি প্রবন্ধটি। পাঠক এই প্রবন্ধটি দিয়েই শুরু করুন।